প্রাচীন রোমের নির্যাতনগুলোর নৃশংসতা এতটাই লাগামছাড়া ছিলো যে, হাজার বছর পর আজও সেসব নৃশংস ঘটনার কাহিনী পড়তে গেলে আপনার বুকের ভেতরটা সামান্য হলেও কেঁপে উঠবে। আজ আপনার সামনে থাকছে প্রাচীন রোমের কিছু অত্যাচারের ঘটনা।
ব্যারেলে নির্যাতন
৮১ থেকে ৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমের সম্রাট ছিলেন ডোমিশিয়ান। রোমান সাম্রাজ্যের একাদশ সম্রাট ছিলেন তিনি। তার শাসনামলে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাসকারী খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেদের উপর নেমে এসেছিলো ভয়াবহ সব নির্যাতন।
বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিলো ব্যারেল দিয়ে সৃষ্ট নির্যাতনটি। এই নির্যাতন পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তির পুরো দেহ প্রথমে মধু ও দুধ দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে দেয়া হতো। এরপর তাকে একটি ব্যারেলে আটকে রাখা হতো, খেতে দেয়া হতো পচে যাওয়া খবার যেসব খাবারে পোকা আর মাছিরা কিলবিল করতো। আর এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ধীরে ধীরে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়তো শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষটি। এই শাস্তিপ্রাপ্ত লোকটি ২ সপ্তাহের বেশি টিকে থাকতে পারতো না। মাত্র ২ সপ্তাহের মধ্যেই ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো আনুমানিক দু’সপ্তাহ পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো সেই দুর্ভাগা।
জীবন্ত কবর দেয়া
রোমান সম্রাট নিরো সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতেন মানুষকে জীবন্ত কবর দিয়ে। এ আনন্দ আরো বেশি হয়ে ধরা দিতো, যখন তিনি কোনো ভেস্টাল ভার্জিনকে তাদের সতীত্ব সংক্রান্ত শপথভঙ্গের জন্য এ শাস্তি দিতেন। একবার তিনি এমন শাস্তি দিয়েছিলেন যাজিকা রুব্রিয়াকে। তাকে একটি ছোট গুহায় আটক করে রেখে আসা হয়েছিলো কোনো রকম দানাপানি ছাড়াই। সেখানেই কিছুদিন পর না খেতে পেয়ে মারা যান তিনি।
অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীকে প্রথমে নিজের কবর নিজেকেই খনন করতে হতো। তারপর সেই কবরে খাড়া করে একটি একপ্রান্ত সূক্ষ্ম চোখা লাঠি। এরপর শাস্তিপ্রাপ্ত লোকটিকে হাত-পা বেঁধে কবরে ফেলা হতো। যদি অপরাধের মাত্রা কম হতো, তাহলে এমনভাবে নিক্ষেপ করা হতো, যেন লাঠির চোখা অংশটি সরাসরি তার হৃদপিণ্ড ভেদ করে চলে যায়, অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। আর যদি কারো অপরাধের মাত্রা কম হতো, তাহলে এমনভাবে নিক্ষেপ করা হতো, যেন সে মারাত্মক রকমের আহত হয়। এরপর তাকে সেখানেই ফেলে আসা হতো, কিংবা দেয়া হতো জীবন্ত কবর।
ক্রুশবিদ্ধকরণ
প্রাচীন রোমের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক শাস্তিদান প্রথা ছিলো ক্রুশে বিদ্ধ করে একজন অপরাধীকে মেরে ফেলা। সবসময় যে তাকে হাতে-পায়ে পেরেক আটকিয়ে মারা হতো, তা কিন্তু না। শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের একেক সময় একেক রকম পদ্ধতিতে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হতো।
কখনো কখনো অপরাধীকে উলঙ্গ করে মাথা ঢেকে দেয়া হতো। এরপর উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো হতো, যতক্ষণ না তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে। কখনো আবার প্রথাগতভাবে হাত-পায়ে পেরেক মেরে আটকে রাখা হতো যতক্ষণ না সেই মানুষটি মারা যাচ্ছে। মৃত্যু প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে মাঝে মাঝে আরো পেটানো হতো তাকে। কখনো লোকটিকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে দেয়া হতো, কখনো আঘাত করা হতো জননাঙ্গে।
একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য জানিয়ে রাখি। পুরো পৃথিবীতে ধীরে ধীরে মৃত্যুদন্ড প্রথা বাদ হয়ে যাচ্ছে। ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুর কথা এখন ভাবাই যায় না। কিন্তু এখনো দক্ষিণ সুদানে অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষদের ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হয়।
মৌমাছির আক্রমণের মাধ্যমে শাস্তি
এই শাস্তি পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হতো মৈমাছিকে। শাস্তির জন্য দোষী ব্যক্তিকে উলঙ্গ করে ঢোকানো হতো বড়সড়, ফাঁকা ফাঁকা করে বোনা বিশেষ একধরনের ঝুড়িতে। সেই ঝুড়ি পরবর্তীতে ঝুলিয়ে দেয়া হতো বড় কোনো গাছের ঢালে। তাকে এমন জায়গায় ঝুলানো হতো যার আশেপাশে কোনে বড়সড় মৌমাছির চাক আছে। মৌচাকের মৌমাছিরা তখন ঝাঁপিয়ে পড়তো লোকটির উপর। হুলের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো শাস্তিপ্রাপ্ত লোকটি।
সিনেটরের ভয়াবহ মৃত্যু
নৃশংসতার দিক থেকে রোমান সম্রাটদের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর সম্রাট ছিলেন সম্রাট ক্যালিগুলা। ক্যালিগুলা ৩৭ থেকে ৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যের ৩য় সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সম্রাট ক্যালিগুলা একবার এক সিনেটরের উপর ভয়ানক রকম চটে যান। আর তাই সম্রাট শাস্তি হিসেবে লোকটিকে চিরে ফেলার আদেশ দেন। চীরে ফেলার পরেও সিনেটর বেঁচে থাকায় সম্রাট নির্দেশ দেন যেনো তার চোখ দুটো উপড়ে ফেলা হয়। এরপর গরম সাঁড়াশির সাহায্যে তার দেহের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো একে একে টেনে বের করা হতে থাকে! আর সবশেষে দেহটি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়া হয়।
প্রাচীন রোমের মানুষজন বিশ্বাস করতো, মৃত্যু আসলে কোনো যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি নয়, বরং এর মধ্য দিয়েই আসে মুক্তি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নির্যাতিত লোকটি এ ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেত বলেই তারা মনে করতো।
যৌনাঙ্গ বেঁধে ফেলা
রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম ঘৃণিত সম্রাট ছিলেন টাইবেরিয়াস। জনগণ সবসময় তার ভয়ে তটস্থ থাকতো। এর পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিলো তার ভয়ানক তিরিক্ষি মেজাজ। মানুষকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তার মাথায় সবসময় নানা রকম আজগুবি চিন্তা-ভাবনা, নিত্যনতুন উপায় ঘুরঘুর করতো।
একবার এক বলিদানের অনুষ্ঠানে সেবাদানরত ভৃত্যকে টাইবেরিয়াসের পছন্দ হয়ে যায়। তার মনে বাসনা জাগে সেই ভৃত্যের সাথে সমকামে লিপ্ত হবার। অবশেষে ক্ষমতাবলে শুধু ভৃত্যকেই না, সেই সাথে তার ভাই, যে কিনা অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজিয়েছিলো, তাকেও ধরে আনান সম্রাট। মনের অসুস্থ কামনা চরিতার্থ করার পর এ নিয়ে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল দুই ভাই। এতে ক্ষেপে গিয়ে তাদের পা ভেঙে দেন টাইবেরিয়াস।
সম্রাট যদি কাউকে শত্রু বলে মনে হতো, তাহলে ছলনা করে তাকে নিজের সাথে মদ্যপানের আমন্ত্রণ জানাতেন টাইবেরিয়াস। অতিরিক্ত মদ্যপানে লোকটি মাতাল হয়ে গেলে শুরু হতো সম্রাটের খেলা। ধারণাকৃত শত্রুর জননাঙ্গ বেঁধে ফেলতেন তিনি। এরপর শুরু হতো নির্যাতন। ভরপেটে এমন নির্যাতনের মুখে মারাত্মক প্রস্রাবের বেগ চাপলেও কিছুই করার থাকতো না সেই দুর্ভাগার!
গাধার ভেতর ঢুকিয়ে রাখা
আগেকার দিনে গাধা ছিল মানুষের জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় প্রাণী। কিন্তু এই গাধাই ছিলো রোমানদের জন্য এক আতঙ্কের নাম। কারন গাধাকে দিয়ে সাধারণ মানুষকে শাস্তি দেওয়া হতো। গাধা দিয়ে শাস্তির কথার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন রোমের লেখক অ্যাপুলিয়াস (ল্যাটিন ভাষায় গদ্য রচয়িতা, প্লেটোনীয় দার্শনিক এবং বক্তা) ও লুসিয়ানের (গ্রীক ব্যঙ্গসাহিত্য রচয়িতা এবং বক্তা) সাহিত্যকর্ম থেকে।
রোমে কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রথমে একটি গাধাকে মারা হতো। এরপর গাধার পেটের সকল নারীভুঁড়ি বের করে ফেলা হতো। এরপর অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে উলঙ্গ করে তার শরীর গাধার পেটে ঢুকিয়ে সেলাই করে ফেলা হতো শুধু শাস্তিপ্রাপ্ত লোকটির মাথা বাহিরে রাখা হতো।
এরপর গাধা বন্দী লোকটিকে উত্তপ্ত রোদের নিচে রেখে দেওয়া হতো। অতিরিক্ত গরমে লোকটির চরম যন্ত্রণা পেতে শুরু করতো। সেই সাথে গাধার মাংস পচতে শুরু করতো। পচা অংশে শুরু হতো পোকামাকড়ের উৎপাত। সেই সাথে মাংসের লোভে কাক শকুনের আক্রমণ শুরু হতো। এভাবে কিছুদিন অমানবিক শাস্তির পর শাস্তিপ্রাপ্ত লোকটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো।
তথ্যসূত্র: Ancient Origin,Wikipedia, History of Ancient Rome