You are currently viewing জ্যাক দ্য রিপার: মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় এক সিরিয়াল কিলার

জ্যাক দ্য রিপার: মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় এক সিরিয়াল কিলার

পৃথিবীতে অসংখ্য সিরিয়াল কিলিং এর ঘটনা ঘটেছে, তাদের মধ্যে অনেকেই নিজের হত্যাপদ্ধতির জন্য বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছেন। কেউ কেউ নিজেদের ধূর্ততায় ফাঁকি দিয়ে বেঁচে গেছেন আইন কিংবা পুলিশের হাত থেকে। তবে এতো এতো সিরিয়াল কিলারদের ভীরে জ্যাক দ্য রিপার কে ছাপিয়ে যেতে পারেন নি কেউ।

শত বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তাকে নিয়ে হচ্ছে গবেষণা। তাকে নিয়ে করা গবেষণার একটা নাম ও রয়েছে ‘রিপোলজি’

সময়টা তখন ১৮ শতকের শেষ দিকের, রাণী ভিক্টোরিয়ার হাত ধরে ইংরেজদের ক্ষমতা ও সাম্রাজ্যের সূর্য তখন তাদের ইতিহাসের শীর্ষে। আর সেই সময়েই ইংল্যান্ডের লন্ডনে ব্রিটিশদের মধ্যে  আতংকের নাম হয়ে উঠেন জ্যাক দ্য রিপার।

১৮৮৮ সালের ৩১ আগস্ট,

দিনটা ছিল শুক্রবার রাত ৩ টা বেজে ৪০ মিনিট; তখন একজন লোক আবিষ্কার করেন একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির নাম অ্যান নিকেলাস। ঘাতক তার শিকারের গলা তীক্ষ্ণ আঘাতে কেটে ফেলেছেন। আর নিঁখুতভাবে মেয়েটির তলপেটের একটি বড় অংশ কেটে নিজের সাথে করে নিয়ে গেছেন। হত্যাকান্ড দেখে ধারণা করা হয়েছিল খুনি বোধহয় নিজের খুনের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতেই এমন কান্ড করেছেন।

আর এই খুনের মাধ্যমেই শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় সিরিয়াল কিলারের সিরিয়াল কিলিং এর ঘটনার। ১৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই খুনের রহস্য কেউ উদঘাটন করতে পারেন নি। সেই সময় খুনি তকমা পান জ্যাক দ্য রিপার নামে।

জ্যাক দ্য রিপার কে ছিলেন?

জ্যাক দ্য রিপার যে সময়টায় খুন গুলো করেছিলেন তখন ব্রিটেনে প্রচুর আইরিশ অভিবাসী ও পূর্ব ইউরোপ থেকে বহু ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রবেশ করতে শুরু করে। তখন আজকের দিনের মতো অভিবাসী প্রবেশের ব্যাপারে এতো নিয়ম ও কড়াকড়ি আইন ছিলো না।

এতো বেশি অভিবাসীর অনুপ্রবেশের ফলে লন্ডনের জনসংখ্যা ফুলে ফেঁপে উঠে, বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের অংশে। যেহেতু অভিবাসীরা ছিলো নিম্নশ্রেণীর তাই চাকরি ও কর্মসংস্থানের সংকট ছিলো বিশাল। আর তাই সেখানে অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণে।

১৮৮৮ সালে তোলা পূর্ব লন্ডনের ছবি Image Courtesy: Home Desirable

খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, মাতলামি হয়ে উঠেছিলো অতি সাধারণ বিষয়। পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের কর্মসংস্থানের অভাব ছিলো আরো বেশি। আর তাই প্রচুর মহিলা নিজেদেরকে পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িয়ে ফেলেন। শুধুমাত্র পূর্ব লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল এলাকাতেই ৬২টি পতিতালয় ছিল আর পতিতার সংখ্যা ছিল ১২০০ এর অধিক।

সে সময়টায় মেরি অ্যানের খুন হওয়াটা সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা অস্বাভাবিক ছিলো না। কারণ খুনের ব্যাপারটা সেই অঞ্চলে স্বাভাবিক বিষয়ই হয়ে উঠেছিলো। তবে তফাৎটা ছিলো এই যে  এর আগের কোনো খুনে নিহতের লাশকে এভাবে বিকৃত করে হত্যা করতে কেউ দেখেনি বা শুনেওনি। খুনের ঘটনাটা পুলিশ ও সাধারণ মানুষজন স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলো। কিন্তু তাদের কেউই চুল পরিমাণ ও আন্দাজ করতে পারেনি যে সামনে কি আসছে, অর্থাৎ এই হত্যা কেবল সিরিয়াল কিলিং এর মাত্র শুরু!

ম্যারি অ্যানের হত্যার ১ সপ্তাহ পরের ঘটনা, ৮ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ সালের শনিবার। একই এলাকায় অ্যানি চ্যাপম্যান নামে আরো এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। পেশায় তিনিও ছিলেন মেরি অ্যানের মতোই একজন পতিতা। লাশের এবারো মেরির হত্যাকান্ডের মতোই তীক্ষ্ণভাবে দুইবার গলাকাটা এবং তলপেটের থেকে নিচের অংশ খুনি কেটে নিয়ে গেছে।

সেই ঘটনায় এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছিল,

উসকোখুসকো কালো চুলের এক ভদ্রলোক অ্যানি চ্যাপম্যান কে তার মৃত্যুর আধ ঘন্টা আগে যেতে দেখেছে।

মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে এমন দুটো নৃশংস হত্যাকান্ডের পর পূর্ব লন্ডনের মানুষদের মধ্যে, বিশেষ করে অভিবাসী পতিতা নারীদের মধ্যে ভয়, আতংক ও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।

আরো পড়ুন:  রাজা অষ্টম হেনরি: প্রেম, রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের এক বিচিত্র জীবন

অ্যানি চ্যাপম্যানের হত্যাকান্ডের প্রায় ৩ সপ্তাহ পরে অর্থাৎ সেই মাসের ৩০ তারিখের ঘটনা। দিনটি ছিলো রবিবার ভোরে এলিজাবেথ স্ট্রাইড আর ক্যাথারিন এডোজ এর লাশ পাওয়া যায়। দুজনকে পাওয়া যায় দু’জায়গায়, এবং দুজনই ছিল পতিতা। অর্থাৎ একই রাত্রে জ্যাক দ্য রিপার দু জায়গায় গিয়ে খুন করেন। ক্যাথরিন কে আগের মতো করেই হত্যা করা হয়, তবে সেই সাথে খুনি জরায়ুর সাথে বাম কিডনিও কেটে নিয়ে গেছে।

এবারো এক প্রত্যক্ষদর্শী বলল, মৃত্যুর আগে এক উসকোখুসকো কালো চুলের লোককে ক্যাথারিনের সাথে দেখেছিল।

এলিজাবেথের মৃত্যুটা ছিলো বাকি খুনগুলো থেকে একটু ভিন্ন। খুবই নিখুঁতভাবে তার প্রধান ধমনী কাঁধের বাম পাশ থেকে কেটে দেয়া হয়েছিল। তবে তলপেটের নিচে কোন আঘাত নেই, ধারণা করা হয় তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যায় খুনী, তাই তলপেটে কোনো আঘাত নেই।

এই জোড়া খুনের পর সেখানের মানুষদের আতঙ্ক বেড়ে যায় আরো কয়েকগুণ বেশি। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও কোনো হদিস পেলো না খুনীর।

জোড়া খুনের ১ মাস পর নভেম্বরের ৯ তারিখ শুক্রবার সকাল পৌনে এগারোটায় মেরি কেলি নামে আরো এক পতিতা নারীর লাশ পাওয়া যায় নিজের ঘরে, নিজেরই বিছানায়। এবারের হত্যাকান্ড আরো বিভ্যৎস!! খুনি এবার গলা ও তলপেট কাটার পাশাপাশি মেরুদণ্ড ও কেটে ফেলেছিলেন। আর শরীর ভেতরের হৃদপিণ্ড কিডনি সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নিয়ে গিয়েছে। খুন দেখে বুঝা যাচ্ছিল এবারের খুনটি খুনি খুব যত্নসহকারে এবং অনেক সময় নিয়ে হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছেন।

এই একই এলাকায় এমা স্মিথ ও মার্থা ট্যাব্রাম নামে দুই নারী খুন হয়েছিলো। তবে এদের খুনের সাথে জ্যাক দ্যা রিপারের খুনের সাথে মিল না পাওয়ায় তাদেরকে জ্যাক দ্য রিপারের শিকার ধরা হয় না। তবে উল্লেখ্য যে এই দুটো খুনই হয়েছিলো উপরের উল্লেখ্য ৫ টি খুনের অনেক আগে।

মেরি কেলির খুনের পর জ্যাক দ্য রিপার চলে যান এমনটা ধারণা করা হয় বা খুন করা থামিয়ে দেন। তবে এই অনুমানের ব্যাপারটি একেবারে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ সেই বছরের ২০ ডিসেম্বর রোজ মাইলেট ও পরের বঋরের জুলাই মাসে অ্যালিস ম্যাকেঞ্জির খুন হয়েছিলো। তবে তাদের কারোরই আগের খুনের মতো অঙ্গ চুরি হয়নি বা জ্যাক দ্য রিপারের খুনের স্টাইলের সাথে মেলেনি তাই তাদেরকেও রিপারের শিকার হিসেবে ধরা চলে না।

এরপর আরো দুটো খুন হয়। একজনের মাথা তো এমনভাবে কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিলো যে নিহতের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অন্যজন ছিলেন ফ্রান্সিস কোলস, মেয়েটিকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল।

সব মিলিয়ে ১.৫ বছরে খুন হয়েছিলো ১১ জন নারী, তাদের মধ্যে ৫ জনের খুন করেছেন জ্যাক দ্য রিপার এ ব্যপারে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই পাঁচ খুনের একটা নাম ও রয়েছে ‘ক্যানোনিকাল ফাইভ’

এতো গুলো হত্যাকান্ডের পর লন্ডনের অবস্থা এমনটা হয়েছিলো যে কেউ কেউ খুন হলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তো যে এই বুঝি জ্যাক দ্য রিপার আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু জ্যাক দ্য রিপার আর কখনে ফিরে আসেন নি। ৫ টি খুন করে তিনি একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।

আরো পড়ুন:  সান্তা ক্লজ: সেইন্ট নিকোলাসের কিংবদন্তি থেকে আজকের জনপ্রিয় চরিত্র

জ্যাক দ্য রিপারকে খুঁজে পেতে পুলিশ তখন প্রায় ২০০০ মানুষকে জেড়া করে, তার মধ্যে তদন্ত করা হয় প্রায় ৩০০ জনের উপর আর গ্রেফতার করা হয় ৮০ জনকে। কিন্তু আসল খুনি আর ধরা পড়েনি। থেকে রয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় অমীমাংসিত কেস হিসেবে।

হত্যান্ড নিয়ে তৈরি গুজব

হত্যাকান্ডের পর থেকেই শুরু হয় তাকে গবেষণা। সৃষ্টি হয় অনেক রকম থিওরির। তারমধ্যে ছিলো কিছু অদ্ভুত থিওরির। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত থিওরি ছিলো রাণী ভিক্টোরিয়ার রাণী প্রিন্স অ্যালবার্টই হচ্ছে জ্যাক দ্য রিপার।

তখন গুজব ছিলো যে প্রিন্স অ্যালবার্টের কোনো এক পতিতা থেকে সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর সেই রাগ থেকেই তিনি একের পর এক পতিতা খুন করেছেন। তবে এই থিওরি ডাহা মিথ্যা। কারণ আলবার্টের আদৌ সিফিলিস ছিলই না। আর যখন খুনগুলা হয়েছিলো অ্যালবাট লন্ডনেও ছিলেন না তাই এই থিওরি ধোপে টেকে নি বেশিদিন।

প্রিন্স অ্যালবার্ট Image Courtesy: Wikipedia

এমন আরো একটি কন্সপিরেসি থিওরি দেন স্টিফেন নাইন ১৯৭৫ সালে লেখা তার এক বইতে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, প্রিন্স আলবার্ট নিম্ন শ্রেণীর এক মেয়েকে বিবাহ করেছিলে, আর সেই বিবাহের খবর যারা যারা জানতো, তাদেরকে একে একে হত্যা করে ব্রিটিশ রাজপরিবার, যেন এই বিয়ের কথা বাইরের কেউ না জানে। এই হাস্যকর তত্ত্ব দ্রুতই বাতিল হয়ে যায়। তবে এ থিয়োরি থেকে পরবর্তীতে হলিউডে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় যার নাম ছিল “From Hell.”

জ্যাক দ্য রিপার নামটি যেভাবে এলো!

হত্যাকান্ডের পর থেকেই পুলিশের ডাক পোস্টে শতশত চিঠি আসতে শুরু করে। সকলেই নিজেদের মতামত ও ভয় ভীতির কথা লিখে চিঠিতে জানাতো। তবে সেই চিঠিগুলোর মধ্যে ভয়ংকর কিছু চিঠি ছিলো কিছু লোক দাবি করে যে চিঠি প্রেরকই খুনি। পুলিশ সেসব চিঠি ভুয়া বলে উড়িয়ে দেয়। চিঠিগুলোর শেষে চিঠির প্রেরক চিঠির নিচে জ্যাক দ্য রিপার নামে সাইন করেছিল। এইসব চিঠির কথা সংবাদমাধ্যমের কানে গেলে জ্যাক দ্য রিপার নামটি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তবে পুলিশের ধারণাই ঠিক এই চিঠিগুলো উড়োচিঠি। জ্যাক দ্য রিপার নামের আগে খুনী “Leather Apron” আর “Whitechapel Murderer” নামে পরিচিত ছিল।

জ্যাক দ্য রিপার নামের আগে সংবাদপত্র গুলো তাকে লিথার অ্যাপরন নামেই সংবাদ প্রকাশ করতো

জ্যাক দ্য রিপার নিয়ে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞদের মতে জ্যাক দ্য রিপার হয়ত পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন, কারণ নিখুঁতভাবে যেভাবে খুনগুলো করা হয়েছিল আর অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো কেটে সরিয়ে ফেলা হয়েছিলো সেগুলো একজন পেশাদার ডাক্তার ছাড়া সম্ভব নয়। আর যেহেতু খুন করেই খুনী সহজভাবেই উধাও হয়ে যেতে পারতো এর মানে এই যে সে রাস্তাঘাট খুব ভালোভাবেই চিনতো অর্থাৎ খুনি পূর্ব লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেলের স্থানীয় অধিবাসী ছিল, আর এজন্যই সে চেনা অলিগলিতে দ্রুত পালিয়ে যেতে পারত। আরেকটি উল্লেখ্য বিষয় হলো, সে কখনও উইকেন্ড অর্থাৎ ছুটির ছাড়া খুন করেনি! আবার অনেকের মতে তিনি হয়তো পূ্র্ব ইউরোপ থেকে আসা কোনো ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক।

জ্যাক দ্য রিপারের রহস্য সমাধান করা সম্ভব না হলেও তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক মুভি, সিরিজ, গেম ও ডকুমেন্টারি। তৈরি হয়েছে অনেক রহস্য উপন্যাস। সেসবে রহস্যের সমাধান দেখানো হলেও বাস্তবে রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে।

Reference: Wikipedia, Britanica Encyclopedia, History, All thats Interesting etc

Mehadi Bhuiyan

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics. He also tutors English. Education: National University of Bangladesh BA in English Literature

Leave a Reply