You are currently viewing ১৮ শতকের লন্ডন শহর: কেমন ছিলো শত বছর আগের লন্ডন শহর?

১৮ শতকের লন্ডন শহর: কেমন ছিলো শত বছর আগের লন্ডন শহর?

১৮ শতকের শুরু সময় সময় থেকেই ইংল্যান্ড ইউরোপের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রিক দেশ হয়ে উঠতে শুরু করে। এর আগে ইউরোপের বাণিজ্য ছিলো প্রায় পুরোটাই ইতালি কেন্দ্রিক। ১৮ শতক থেকেই ইংল্যান্ডের লন্ডন শহর সভ্যতা ও ধনসম্পত্তিতে নিজের আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। লন্ডন ছিলো সেসময়ে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা। শুধু ইংল্যান্ডই নয় তা পুরো ইউরোপের গুরুত্ব বহন করতে শুরু করে।

আর এই লন্ডন শহরের প্রধান ছিলেন লন্ডনের মেয়র। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। আর তাই নিজের শ্রেণী ও আভিজাত্যের প্রমাণ দিতে তিনি সাধারণ মানুষের মাঝে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই জনসম্মুখে আত্মপ্রকাশ করতেন। রাজকীয় পোশাক, বেশভূষা ও অলংকার পরিধাণ করতেন তিনি। আর সাথে থাকতো একটি বড়ো রক্ষী বাহিনী ও ভৃত্যের দল। 

সে সময়ে একটি প্রচলিত কথাই ছিলো, “যার লন্ডন ভালো লাগে না তার জীবনটাই ভালো লাগে না।”

তবে ১৮ শতকের প্রথমার্ধ ও দ্বিতীয়ার্ধের লন্ডন শহরের চেহারার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। ১৮ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের লন্ডনের থেকে প্রথমার্ধ ছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে লন্ডনের রূপ ও সৌন্দর্য দুটোই বিকশিত হয়েছে।

১৮ শতকের শুরু দিকে লন্ডন শহর ছিলো খুবই সাদামাটা। লন্ডন শহরের রাস্তাগুলো ছিলো খুবই সরু। এতোটাই সরু যে রাস্তার দুই পাশ দিয়ে দুটো গাড়িও ঠিকমতো যেতে পারতো না। বাস্তার আশেপাশের ঘরবাড়িগুলো ছিলো ইট ও কাঠের তৈরি। রাস্তায় কোনো ফুটপাত ছিলো না। সাধারণ মানুষজন রাস্তায় মাঝখানেই হাটতো। লন্ডনের সাধারণ মানুষরা তাদের বাড়িঘরের ময়লা আবর্জনা বাড়ির জানালা দিয়েই ফেলে দিতো। কখনো কখনো দেখা যেতো সেই ময়লা রাস্তায় হেঁটে চলা কোনো পথচারীর মাথার উপরেই গিয়ে পড়েছে।

Photo Courtesy: Mr pepay small change

বর্ষাকালে লন্ডনের অবস্থা ছিলো আরো ভয়াবহ। লন্ডনের সারা রাস্তাজুড়ে কালো পানিতে ভরে যেতো। আর সেই পানির সাথে ভেসে যেতো শহরের সকল ময়লা আবর্জনা, মরা কুকুর বিড়াল থেকে শুরু করে আরো কতো কি! আর সেইসব ময়লা পানিগুলো গিয়ে পড়তো টেমস নদীতে।

১৮ শতকের শুরু দিকে রাতের বেলায় লন্ডন শহরে তখনো আলো আসেনি। রাস্তাগুলো ছিলো পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন। ফলে চোর, পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারীদের উপদ্রব ছিলো ভয়াবহ রকমের। রাস্তাঘাটে বখাটে ছেলেদের উপদ্রব ও ছিলো। ফলে ভদ্র ঘরের মেয়েরা রাতের বেলা তো দূর তারা দিনের বেলাতেও রাস্তায় বের হওয়ার সাহস করতো না। রাস্তায় চলাচল করার চেয়ে লন্ডনের মানুষজন জলপথেই যাতায়াত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত প্রায় সকলেই নৌকায় যাতায়াত করতো। নৌকোগুলো তখন বিভিন্ন রঙে সুসজ্জিত থাকতো।

লন্ডন শহরের বাড়ি ঘরগুলোতে তখন নম্বর থাকতো না। কারণ শহরের অধিকাংশ মানুষই ছিল অশিক্ষিত। আর তাই নম্বরের পরিবর্তে বাড়ি গুলোর সামনে চিহ্ন বা ছবি এঁকে রাখা হতো যেনো সব মানুষই বুঝতে পারে। লন্ডনের প্রায় সব দোলান, সরাইখানা, থিয়েটার কিংবা কফি হাউস সব জায়গাতেই রঙবেরঙের ছবি আঁকা হতো। ছবিগুলো হতো বিভিন্ন প্রাণী গাছপালা ফুল কিংবা মানুষের মুখশ্রী এমনকি আরব বেদুঈনদের চিত্রকর্মও দেখা যেতো।

লন্ডনের সাধারণ মানুষের বাড়িঘর এমনই ছিল Image Credit: Eurogamer

ফেরিওয়ালারা শহরের রাস্তার উপরেই জিনিসপত্র ফেরি করে বেঁচা হতো। পুরুষ মহিলা কিংবা বালক ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে যেতো আর চিৎকার করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো জিনিপত্র কেনার জন্য। কখনোবা চিৎকার করার পরিবর্তে একাধারে ঘন্টা বাজাতো।

রাণী অ্যানীর রাজত্বকাল থেকে ইংল্যান্ড ও লন্ডনের মানুষদের জীবনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এসময় ইংল্যান্ডে ব্যবসা বাণিজ্য ও রাজনীতির বিশাল পরিবর্তন ঘটে। ইট পাথরে ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরের পাশাপাশি অন্যান্য শহরগুলোতেও অবকাঠামোগত উন্নতি হতে শুরু করে। সেই সাথে বাহিরের দেশ থেকে নানা ধরনের জিনিসপত্র আসতে শুরু করে। বিশেষ করে চীনা মাটির আসবাবপত্রে গৃহ সজ্জিত হতে লাগল অধিক পারমানে। অন্যদিকে রাজনীতিতে দুটি দলের আবির্ভাব ঘটল। এই দুটি দল হুইগ এবং টোরী নামে পরিচিত ছিল। হুইগরা ছিল প্রগতিপন্থী, অন্যদিকে টোরীরা ছিল রক্ষণশীল। 

ইংল্যান্ডের ব্যবসা-বাণিজ্য সুদূর প্রাচ্যদেশেও ব্যাপক বিস্তার লাভ করতে আরম্ভ করেছিল। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় ইংল্যান্ড অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ লাভবান হয়েছিল, ভারত থেকে নানান দ্রব্য ইংল্যান্ডে আমদানি হতো। লন্ডনের বাজার তখন বিদেশি পণ্যে ভরে গেছে। বিদেশ থেকে আসতে লাগল সিল্ক, মশলাপাতি, চা ও কফি, চীনের পোর্সিলিনের মতো দামি জিনিসপত্র। আর কফি আমদানির ফলে বিত্তবান শ্রেণির পান অভ্যাস বদলে গেল। লন্ডন শহরে গড়ে উঠল অসংখ্য “কফি হাউস” আর এই কফি হাউসগুলো ছিল সমাজজীবনের মহামিলন কেন্দ্র।

রাণী অ্যানির সময়েই লন্ডনে প্রায় ৬০০ কফি হাউস গড়ে উঠে। কফি হাউস গুলোতে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটাতো। দেশের ধর্ম রাজনীতি কিংবা সাহিত্য ছিলো সেখানকার আলোচনার মুখ্য বিষয়।

কফি হাউসগুলোতে শুধু কেবল চা কিংবা কফিই বিক্রি হতো না। সেখানে দৈনিক সংবাদপত্র ও থাকতো। ফলে ইংল্যান্ডে দৈনিক সংবাদপত্রের প্রচলন শুরু হয়। অনেকেই খবর পড়ার জন্য হলেও কফি হাউসগুলোতে ভীর করতো। এই কফি হাউসগুলোতে রাজনীতিক থেকে শুরু করে সাহিত্যিকদের ও আনাগোনা থাকতো। তাদের কথাবার্তা অন্যান্য সাধারণ মানুষেরা মনযোগ দিয়ে শুনতো।

কফি হাউসগুলোর আধিপত্য এতটাই বেশি ছিলো যে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলে বের হতো কেউ তার খোঁজ করলে যেনো তাকে কফি হাউসের কথা বলে দেয়। 

বাণিজ্যের ফলে লন্ডন শহর হয়ে বিশ্বসভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। জ্ঞান, বিজ্ঞান আর বাণিজ্যের প্রধান শহর হয়ে উঠে লন্ডন। লন্ডন হয়ে উঠে আধুনিক সভ্যতার পীঠস্থান। কি সৃষ্টি হয়নি তখন লন্ডনে? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আদালত, বন্দর, যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, কয়েদখানা, সুবিশাল টাওয়ার, পার্ক থেকে সবকিছু। লন্ডন হয়ে উঠে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী শহর। 

Leave a Reply