দ্য আউটসাইডার ফরাসি লেখক ও দার্শনিক আলবার্ট কামুসের একটি বিখ্যাত ফিলোসফিক্যাল উপন্যাস। আকারে ছোট হওয়ায় এই উপন্যাসটিকে নোবেলা অর্থাৎ ছোট উপন্যাস বলা হয়। আলবার্ট কামুসের এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ফরাসি ভাষায় L’Étranger নামে। পরবর্তীতে ইংরেজিতে অনুবাদ হলে মার্কিন ইংরেজি অনুবাদে উপন্যাসের নামকরণ করা হয় The Stranger নামে আর ব্রিটিশ ইংরেজিতে নাম করা হয় The Outsider নামে।
আলবার্ট কামুসের এই উপন্যাসটিকে ফিলোসফিক্যাল উপন্যাস বলার কারণ হচ্ছে তিনি এই উপন্যাসে এক্সিটিয়ালিজম বা অস্তিত্ববাদ, অ্যাবসার্টিজম ও নিহিলিজমের মত দার্শনিক তত্ত্বের ব্যবহার ঘটিয়েছেন। যেগুলোর সার্বিক অর্থ হচ্ছে মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব সবকিছুই অর্থহীন।

আলবার্ট কামুস উপন্যাসের সময়কাল হিসেবে বেছে নিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ের অর্থাৎ ১৯৩০ এর দশকের আলজেরিয়াকে। আলজেরিয়া তখন ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মারসো। একই সাথে তিনি এই উপন্যাসের ন্যারেটর অর্থাৎ বর্ণনাকারী। মারসো আলজেরিয়ার একটি অফিসে কেরানির কাজ করেন। তার অফিসের বস তাকে প্যারিসে বদলি করার সুযোগ দিলেও তা সে গ্রহণ করেনি। এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে তার চাকরির দ্রুত উন্নতি ঘটতো। তার চাকরির প্রতি আগ্রহের অভাবই বোঝায় যে তিনি সমাজের প্রচলিত “উন্নতি” ধারণাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না।
উপন্যাসের শুরু হয় মারসোর মায়ের মৃত্যু দিয়ে। উপন্যাসের শুরুতে মার্সো তার মায়ের মৃত্যুকে বর্ণনা করেন এভাবে যে, “Maman died today. Or maybe yesterday, I don’t know.” মারসোর মা মামান আজ কিংবা গতকাল মারা গেছে সে ব্যাপারে তার কোন ধারনা নেই। মায়ের মৃত্যুতে তাকে কষ্ট বা শোকাহত হতে দেখা যায় না।
বিশ্বাসের দিক থেকে মারসো একজন নাস্তিক। মানুষ জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ এসব তার কাছে খুবই সাধারণ বিষয়। তার চরিত্রের মধ্যে সংবেদনশীলতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। কোন ঘটনাকেই সে ভালো বা মন্দ বলে বিচার করে না, তিনি কেবল শুধু পর্যবেক্ষণ করেন।
মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে সে তার অফিস থেকে দুই দিনের ছুটি নিয়ে বাসে করে মায়ের বৃদ্ধাশ্রম মারেঙ্গেতে যান। বাসে চলার পুরোটা সময় তিনি ঘুমিয়ে কাটান। মায়ের মৃত্যুতে তাকে কোনো শোক, দুঃখ বা অনুতাপ করতে দেখা যায় না।
বৃদ্ধাশ্রম এর পরিচালক তাকে তার মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখতে চাই কিনা জানতে চাইলে মারসো দেখতে চায় না বলে জবাব দেয়। নিয়ম অনুযায়ী মৃত লাশের সাথে তার আত্মীয়কে একরাত কাটাতে হয়। মারসো সেই বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ারটেকারের সাথে করে পুরো রাত লাশের পাশেই কাটান কফি আর সিগারেট পান করে। এরপরের দিন সকালেই মারসোর মায়ের শেষকৃত্যের আয়োজন করা হয়। সেই শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানের সময় বৃদ্ধাশ্রম এর থমাস প্যারেজ নামের এক বয়স্ক ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলেন এই বৃদ্ধাশ্রমে মারসোর মায়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষ।
এই উপন্যাসে আলো একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আলোর সাথে সাথে মার্সোর সাইকোলজিক্যাল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। মারসো যে রাতে তার মায়ের মৃতদেহের পাশে কাটিয়েছিলেন সেই ঘরটি ছিলো প্রচণ্ড উজ্জ্বল। কারণ জানালার পাশে থাকা বাতিগুলো জ্বলছিল।আলো ও গরমের জন্য মোঁরসো ক্লান্ত ও অস্বস্তিকর বোধ করে। গভীর রাতে তার চোখ তন্দ্রায় ভারী হয়ে আসলেও সে ঘুমাতে পারেনি আলোর জন্য।
পরেরদিন যখন তার মায়ের অন্তেষ্টিক্রিয়ার কাজ শুরু হয় তখন মারসো বারবার সূর্যের তীব্রতার কারণে তার বিরক্তির কথা উল্লেখ করেন। সূর্যের আলোর তীব্রতায় তার কপাল ঘামে ভিজে যায়, চোখ জ্বলতে থাকে, এবং মাথাব্যথা শুরু হয়।সে বারবার বলে, এই গরম তার কাছে অসহনীয় লাগছে।এই সূর্য ও গরম শুধু একটি আবহাওয়া নয়, বরং মোঁরসোর মানসিক অবস্থার প্রতিচিত্র। মারসো শোক বা আবেগের বদলে সে শারীরিক অস্বস্তি নিয়ে বেশি সচেতন।

মায়ের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানের পরেই মারসো সেখান থেকে তার বাসায় চলে যায়। মায়ের মৃত্যুর কোন শোকই যেন তাকে স্পর্শ করেনি। মারসো সমুদ্র সৈকতে সাঁতার কাটতে যায়। আর সেখানেই এককালের সহকর্মী মারি কার্ডোনার সাথে দেখা হয়। তারা দুজন একসাথে সমুদ্রে সাঁতার কাটে এরপর দুজন একসাথে মিলে সিনেমা দেখতে যায়। সিনেমা দেখার পর তারা দুজন একসাথে রাত্রি যাপন করে। পরেরদিন সকালে মারসোর গার্লফ্রেন্ড মারি কার্ডোনা সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর মারসো সারাদিন ঘর ও বারান্দায় হেঁটে ও শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেয়।
মারসোর জীবন তার আগের স্বাভাবিক জীবনের মতই চলতে থাকে। মায়ের মৃত্যুতে তার জীবনে ন্যূনতম পরিবর্তনও আসেনি। পরের দিন মারসো তার স্বাভাবিক জীবনের মতই আবার তার কাজকর্মে ফিরে যায়। অফিসে সে তার সহকর্মী ইমানুয়েল এর সাথে লাঞ্চ করে এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করার পর বাসায় ফিরে আসে।
বাসায় ফিরে আসার পর মারসোর এর সাথে তার প্রতিবেশী রেমন্ড সিন্টেসের দেখা হয়। এই রেমন্ড সিনটেন্স একজন নিচু শ্রেণীর মানুষ। সে একজন পতিতার দালাল, তবে নিজেকে সে একজন কেয়ারটেকার হিসেবে পরিচয় দেয়। রেমন্ড মারসোকে তার বাসায় রাতের ডিনার করার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। সেই ডিনারে রেমন্ড মারসোকে বলে তার একজন আরব প্রেমিকা আছে। সেই প্রেমিকা তার থেকে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং এখনো তাকে টাকার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে, আর তাই সে তার প্রেমিকাকে প্রহার করেছে। প্রেমিকাকে মারধর করার কারণে সেই প্রেমিকার ভাই রেমন্ডকে হুমকি, ধামকি ও পুলিশের ভয় দেখায়। রেমন্ড মারসোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেয় যেনো মারসো তার পক্ষ হয়ে পুলিশের কাছে সাক্ষ্য দেয়।
মারসোর সালামানো নামে আরো এক বৃদ্ধ প্রতিবেশী আছে। এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের একটি কুকুর আছে। কুকুরটিকে তিনি সবসময় প্রহার করেন। কিন্তু কুকুরটি হারিয়ে গেলে সালামানো গভীর শোকাহত হন। তিনি কুকুরটিকে পুলিশের মাধ্যমে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। সামাজিক সংযুক্তি ও সম্পর্ক মানুষকে আবেগপ্রবণ করতে বাধ্য। এই চরিত্রের মাধ্যমে আলবার্ট কামুস সেই বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
পরের দিন মারসোর গার্লফ্রেন্ড মারি কার্ডোনা মার্সোর বাসায় আসেন। মারসো তার গার্লফ্রেন্ডের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বোধ করলেও তার প্রতি তার কোন আবেগ নেই। প্রেম ও বিয়ের ব্যাপারে মারসোর এর কোন আগ্রহ নেই। এই সব কিছুই সামাজিক প্রথা। মারসো কোন সামাজিক প্রথায় বিশ্বাসী নয়।
মারসোর গার্লফ্রেন্ড মারি কার্ডোনা মারসোকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মারসো নির্লিপ্ত ও আবেগহীন প্রতিক্রিয়া দেখায়। বিয়ের ব্যাপারে মারসো বলে It didn’t matter to me, but if she wanted to, we could get married.অর্থাৎ এর কোনো অর্থ নেই, তবে যদি তুমি চাও, তাহলে আমরা বিয়ে করতে পারি। মারি কিছুটা হতাশ হয়, কারণ সে আশা করেছিল মারসো হয়তো তাকে ভালোবাসার কথা বলবে বা বিয়ের বিষয়ে উচ্ছ্বাস দেখাবে। কিন্তু মার্সো একইভাবে নির্লিপ্ত থাকে এবং বলে যে, “Marriage is not important.”
তাদের দুজনকারই কথাবার্তার মাঝখানে তারা রেমন্ডের চিৎকার শুনতে পায়। তারা রেমন্ডের বাসায় গিয়ে দেখতে পায় পুলিশ তাকে চড় থাপ্পর দিচ্ছে; কারণ সে তার প্রেমিকাকে শারীরিক নির্যাতন করেছে। রেমন্ড পুলিশকে জানায় সে পরে থানায় গিয়ে সাক্ষাৎ করবে।
মারসো তার গার্লফ্রেন্ড ও রেমন্ড সমুদ্রের কাছে রেমন্ডের এক বন্ধু ম্যাসনের কটেজে ঘুরতে যায়। তারা সেখানে খাবার খায় এরপর তারা সমুদ্রের তীরে হাঁটতে বের হয়। সেই সময় তারা লক্ষ্য করে তাদেরকে দুইজন আরব লোক ফলো করছে। তাদের মধ্যে একজন হল রেমন্ডের আরব প্রেমিকার ভাই যাকে সে শারিরীক নির্যাতন করেছে। সেসময় তাদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও সেদিন কোনো সংঘর্ষ হয় না।
পরের দিন মারসো, রেমন্ড ও ম্যাসন তিনজন বীচে ঘুরতে যায়। তখন আবারো তাদের সাথে সেই দুই আরবের দেখা হয়। রেমন্ডের সেই প্রেমিকার ভাই রেমন্ডকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে, কিন্তু বড় কোনো ক্ষতি তার হয়নি। রেমন্ড আহত হলে তারা ম্যাসনের সমুদ্রের কটেজে ফিরে আসে।
সেইদিনই মারসো একাকি সমুদ্রের তীরে যায়। মারসো সেই আরব লোকটিকে দেখতে পায়। লোকটির হাতে তখনো ছুরি ছিলো। সেসময় সমুদ্রের তীরে সূর্যের প্রখর আলো পড়ছিলো। আর সমুদ্রের বীচের বালুতে সেই আলো পড়ার ফলে গরম লাগছিলো অনেক বেশি। আলো আর গরমের ফলে মারসের ভেতরে একটা মানসিক পরিবর্তন আসে। এখনো তাই ঘটলো। সেই আরব লোকটির হাতে থাকা ছুরির ফলাতে সূর্যের আলোর রিফলেকশন মারসোর চোখে এসে লাগছিলো।
মারসোর আলোর প্রতি তখনকার বিরক্তি তিনি প্রকাশ করছিলেন এভাবে, “The dazzling spear still leaping from the knife scoured my eyelashes and gouged my eyeballs…”
মারসোর পকেটে একটি পিস্তল ছিলো সে সেটি বের করে আরব লোকটিকে গুলি করে। প্রথম করা গুলিতেই আরব লোকটি মারা যায়। তবুও মারসো লোকটিকে আরো চারটি গুলি করেন।
খুনের অপরাধে মারসোকে জেলখানায় বন্দি করা হয়। জেলখানার প্রায় সব কয়েদি ছিল আরব। তারা যখন জানতে পারে যে সে একজন আরব লোককে হত্যা করেছে; তা শুনে আরব কয়েদিরা তাকে ভয় পায়। কারাগারে প্রথম দিকে মারসোর বিরক্ত লাগছিল। সে তার পূর্বের জীবনযাপনকে মিস করতে থাকে। কারাগারে থাকার সময় সে বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে ও বিভিন্ন রকম চিন্তা ভাবনা করেই কাটিয়ে দেয়।
মারসোর অপরাধের বিচারকার্য শুরু হয় কিন্তু মারসোর কোন উকিল ছিল না। বিচারক মারসোকে উকিলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে বলে তার উকিলের প্রয়োজন নেই। আদালতের পক্ষ থেকে মারসোর জন্য একজন উকিল নিয়োগ দেয়া হয়। আদালতের বিচারকার্যের বেশিরভাগ সময়ই সে ভাবলেশহীন অবস্থায় থাকে।
তার এমন চুপচাপ ও ভাবলেশহীন থাকার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মারসো বলেন, I don’t see why i should have said anything.
তার এমন চুপচাপ ও ভাবলেশহীন থাকা দেখে আদালতের বিচারক ধরে নেয় তার মধ্যে কোন আবেগ-অনুভূতি বা ভালোবাসা নেই। বিচারকার্য শুরু হলে মারসোর বিরোধী উকিল প্রমাণ দেখায় যে মারসো একজন নিষ্ঠুর মানুষ। প্রমাণ হিসেবে তারা মারসোর মায়ের বৃদ্ধাশ্রমের ডাইরেক্টর ও কেয়ারটেকারের জবানবন্দি নেয়। তারা আদালতকে জানায় মারসো তার মায়ের মৃত লাশের মুখও দেখতে চাইনি। তারা তার মধ্যে কোনো দুঃখ কষ্ট বা শোক দেখেনি। এমনকি সে সারারাত মায়ের লাশের পাশে কফি ও সিগারেট পান করে কাটিয়েছে। বিরোধী পক্ষের উকিল আরো বলে যে মায়ের মৃত্যুর পর সে গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বিচে সাঁতার কেটে, সিনেমা দেখে ও ফুর্তি করে সময় কাটিয়েছে।
মারসোর এই খুনের ঘটনা একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের স্বাভাবিক ও অনিচ্ছাকৃত ঘটনার মতো ছিল, যা তার অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অংশ। খুনটি তার কাছে কোনো ব্যক্তিগত প্রতিশোধ, ঘৃণা বা পরিকল্পনা ছিল না। তিনি নিজের হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো প্রকার আবেগ বা অনুভূতি দেখাননি।
মারসো আদালতে বলেন,“I didn’t have any reason to kill him. I did it because I had to.”
আদালতের বিচারকার্য নিয়ে মারসোর কোন ভাবনাই ছিলো না। আদালত যখন তার মৃত্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন মারসো চিন্তা করছে উকিলের টাইটা বেশ সুন্দর কিংবা আদালতে আজ খুব গরম পড়েছে এসব অহেতুক বিষয় নিয়ে।
মারসোকে বিচারক তার মা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলো Did you love your mother? মার্সো সেই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলো Yes, the same as anyone. আলদাতে তার মায়ের বৃদ্ধাশ্রমে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করলে মারসো জবাবে বলেছিলো সে তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছিল কারণ সে একা থাকতো এবং তার মায়ের দেখাশোনা করা ও খরচ বহন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মারসো সেইসাথে এটাও যুক্তি দিয়েছিল যে বৃদ্ধাশ্রমে তার মা নতুন বন্ধুবান্ধব পেয়েছিলেন এবং সেখানে বেশ ভালোই ছিলেন।
মারসোর সাথে তার মায়ের সম্পর্ক উষ্ণ বা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো না। তার মা ৩ বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে থাকলেও মারসো তার মায়ের সাথে খুব একটা দেখা করতে যায় নি। উপন্যাসের শুরুর দিকের এক বর্ণনায় সে তার মা সম্পর্কে বলেছিলো
“When she was here, Mother used to spend her time watching me in silence.”
মারসোর বিচার চলাকালীন পুরোটা সময় মারি আদালতে উপস্থিত ছিল। মেরি মারসোর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল, তার উপস্থিতি এবং তাদের সম্পর্ক আদালতে মারসোর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। বিচারের পুরোটা সময় মেরি আদালতে বসে থাকত, কিন্তু মারসোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারত না। একপর্যায়ে মারসো লক্ষ্য করে যে, প্রতিদিনের শুনানির সময় মারি ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ দেখাচ্ছে, কারণ সে বুঝতে পারছিল যে বিচারক এবং প্রসিকিউটর তার কথাগুলোকে মারসোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।
কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারি মারসোর সাথে একবার দেখা করতে এসেছিল। মেরি যখন মারসোর সঙ্গে দেখা করতে আসে, তখন তারা কাঁচের দেয়ালের দুই পাশে বসেছিলো। তারা টেলিফোনের মাধ্যমে কথা বলে, কিন্তু মারসো অনুভব করে যে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে—শারীরিকভাবেও এবং মানসিকভাবেও।মারি তাকে জানায় যে সে চেয়েছিল তারা আবার একসঙ্গে থাকুক এবং বিয়ে করুক, কিন্তু এখন মনে হয় এটি আর সম্ভব নয়। তার কণ্ঠে দুঃখ এবং ব্যথার ছাপ ছিল, কিন্তু মারসো তার স্বাভাবিক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই কথাগুলো গ্রহণ করে। এরপর মারি আর মারসোর সাথে দেখা করতে আসেনি। সম্ভবত সে পরিস্থিতি মেনে নিয়েছিলো কিংবা পরিবার ও সমাজের চাপে মারসো থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।
মারসোর আইনজীবী তার সাথে জেলখানায় দেখা করতে আসে। মারসোর চুপচাপ আর ভাবলেশহীন আচরণে তিনি বিরক্ত হন। যখন তিনি মারসোর কাছে শুনতে পান, যে লোকটির ছুরিতে পরা সূর্যের আলোর রিফ্লেকশন তার বিরক্ত লাগছিল বলেই সে আরব লোকটিকে গুলি করে হত্যা করেছে তা শুনে আইনজীবীর মেজাজ খারাপ হয়। তিনি মারসোকে তার অনুমতি ছাড়া বিচারকার্যে কথা বলতে বারণ করেন। ছুরিতে সূর্যের আলো রিফলেকশনে বিরক্ত হয়ে মারসো আরব লোকটিকে খুন করেছে এই কথাটি বিচারককে বলতে গিয়েও তিনি বলেননি। কারণ আদালত তার এই অদ্ভুত যুক্তি কখনোই মেনে নেবে না বরং মামলায় এই যুক্তি তুললে মামলা মারসের আরো বিপরীতে চলে যাবে।
আদালত মারসোকে গিলেটিনের মাধ্যমে মৃত্যুর নির্দেশ দেয়। মারসো একজন আরবকে গুলি করে হত্যা করেছেন সেজন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়নি। তাকে মূলত মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে এজন্য যে সে তার মায়ের মৃত্যুর সময় শোক বা দুঃখ পায়নি এইসব বিবেচনা করে। মারসোকে কেনো কোনো সুখ দুঃখ স্পর্শ করে না এটাই বিচারকের কাছে মারসের প্রধান দোষ। এছাড়া সে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসী না। জীবন নিয়ে তার কোন ভাবনা নেই; নেই কোন উদ্দেশ্য। এসব কিছু চিন্তা করেই বিচারক মারসোর মৃত্যুদণ্ড দেয়।
মারসো কিন্তু চাইলেই বিচারে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারতেন। লোকটির হাতে ছুরি ছিল আর নিজের আত্মরক্ষার্থে সেই লোকটিকে হত্যা করেছে, এমন অজুহাত দিয়ে সে মুক্তি পেতে পারতো। তিনি একজন সৎ মানুষ এদিকটা বিবেচনা করলে। তার কাছে সুযোগ থাকলেও সে অন্যায় ভাবে তা ব্যবহার করেনি। মারসো লোকটিকে একপ্রকার খেয়ালের বসে খুন করেছে। এই ব্যাপারটার সাথে ফিওদর দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত উপন্যাস ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট এর মিল পাওয়া যায়। ক্রাইমেন পানিশমেন্ট উপন্যাসের রাসকলনিকভ ও এক ইহুদি কুসীদজীবী মহিলাকে হত্যা করেছিলেন স্রেফ খেয়ালের বসে। জেনে রাখা ভালো আলবার্ট কামুসও দস্তয়েভস্কি’র দর্শনে প্রভাবিত ছিলেন।
আদালত মারসোকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলেও মারসোর মধ্যে কোনো প্রকার ভয় বা আতঙ্ক কোনো কিছুই লক্ষ্য করা যায়নি। মৃত্যুদণ্ডের আগে কারাগারে মারসোর সাথে একজন পাদ্রী দেখা করতে আসেন। পাদ্রী জানতে পারেন যে মারসো একজন নাস্তিক, সে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না। পাদ্রী মারসোকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তার ঈশ্বরী বিশ্বাস আনা উচিত। এতে করে সে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে শান্তি পাবে।
মারসো পাদ্রীকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে সে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না আর তাই সে প্রার্থনা করবে না। প্রথমদিকে মারসো শান্তভাবে পাদ্রির কথা শুনে। কিন্তু সে বারবার এক কথা শুনতে শুনতে সে পাদ্রীর উপর রেগে যায়।
মারসো পাদ্রিকে চিৎকার করে বলে,
Nothing mattered and I knew why. He knew why.
মারসোর কাছে জীবন ও মৃত্যু সমান অর্থহীন। মারসোর সাথে কোন যুক্তি ও তর্কে না পেরে পাদ্রী সেখান থেকে চলে যায়। আর মারসো অপেক্ষা করতে থাকে মৃত্যুর জন্য। এখানেই উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে।