রোমান্টিক যুগেের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শেলীর জন্ম হয়েছিল ইংল্যান্ডের গ্রামের এক অভিজাত পরিবারে। শেলীর পিতা ছিলেন খুবই আদর্শবাদী মানুষ। আপন গৃহের মধ্যে বোনদের সঙ্গে শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল শেলীর। তারপর ইটন স্কুলে। সেখানে শেলীর অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। পড়াশোনার বিষয়ে কোনোরকম জোরজুলুমের প্রতি তিনি ছিলেন ঘোরবিরোধী। স্কুল শিক্ষকের হাতের বেতকেও তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি আর সব ছাত্রদের থেকে একটু স্বতন্ত্র ধরনের ছিলেন। তাই শেলীর সঙ্গে শিক্ষক কিংবা সহপাঠী কারোসাথেই বনিবনা ছিল না।
স্কুল জীবন সমাপ্ত করে শেলী ১৮০৮ সালে অক্সফোর্ডে ভর্তি হন। শেলীর বয়স তখন মাত্র আঠারো! ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে ইতিমধ্যে তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন। এখানেই তার ভাগ্নী হ্যারিয়েট যোভের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় হয়েছিল টমাস জেফারসন হগের সঙ্গে। হগ ছিলেন সংশয়বাদী, টোবী দলের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সব কিছুতেই সংশয় প্রকাশ করা ছিল তার অভ্যাস। শেলীর মধ্যে তা প্রভাব বিস্তার করেছিল। আর এর ফলেই শেলী রচনা করে ফেললে ‘The necessity of Atheism’ (নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা)।
এই রচনা আত্মপ্রকাশ করার পরেই ঝড় উঠল। শেলী এবং তার বন্ধু টমাস হগকে বিদায় নিতে হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত শেলীর জীবন তখন অনিশ্চিত ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল। বাবা চেষ্টা করলেন হগের সংসর্গ থেকে মুক্ত করতে কিন্তু আস্কারা দিলেন শেলীকে শেলীর খুঁড়ো পিলফোল্ড এবং বোনেরা। একসময় বাধ্য হয়ে তার বাবা তাকে তাজ্য করে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর বিভিন্ন ভাবে শেলী তার বোন এলিজাবেথকেই ‘ নাস্তিক ‘ বানিয়ে তুলতে চেষ্টা করল। শুধু বোনকে নয়, বোনের সহপাঠিনী বন্ধু হ্যারিয়েটকেও। হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রক সম্ভ্রান্ত কফি হাউস মালিকের সন্তান। শেলী যখন হ্যারিয়েটকে ‘ নাস্তিক ‘ বানালেন তখন দেখা গেল যে দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছেন। ফলে দুজনেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন ১৮১১ সালে এডিনবরায় বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হলেন। অনভিজ্ঞ দম্পতি। কষ্টের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন । দীরে ধীরে প্রথম প্রণয়ের উন্মাদনা গেল কেটে প্রথমা কন্যার আবির্ভাবের সাথে সাথে দুজনের মধ্যে অভাবের খুঁটিনাটি নিয়ে শুরু হলো বিবাদ। তা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে দুজনকে বিচ্ছেদের প্রান্ত সীমায় টেনে আনল।
এই সময় শেলীর সঙ্গে প্রখ্যাত লেখক উইলিয়াম গডউইনের পরিচয় হয়। তার ষোড়শী কন্যা মেরির সঙ্গে শেলী পড়লেন প্রেমে। আর এই প্রেম হ্যারিয়েটকে হানল প্রচণ্ড আঘাত। সহ্য করতে না পেরে হ্যারিয়েট আত্মহত্যা করে বসলেন। ফেলে রেখে গেলেন দুটি সন্তান যাদের ভার নেবার দায়িত্বও আদালত শেলীকে দিল না হ্যারিয়েটের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে শেলী মেরীকে বিবাহ করেন সেটা ১৮১৬ সাল। বেশ কিছুদিন ধরে শেলীর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। দেশভ্রমণে বেরিয়ে ইতালিতে এলেন। এখানেই বসবাস করতে লাগলেন। এখানে লে হান্ট , পিকক , হগ , বন্ধু জুটেছিল। ইতালির জীবন শেলীর বেশ সুখেই কাটছিল। কিন্তু সে জীবনেও এল সমাপ্তি।
শেলী চিরকালই অস্থির ধরনের ছিলেন। ১৮২২ সালের জুন মাস। লে হান্ট বায়রনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। জুলাই মাসের ৮ তারিখ। শেলী বন্ধু উইলিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ক্ষুদ্র নৌকাটা আনার জন্যে বেরিয়ে গেলেন। সেদিন সন্ধ্যায় শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি। সেই ঝড়ের মুখে পড়ে শেলীর নৌকা গেল ডুবে। পনেরো দিন পরে তাঁদের মৃতদেহ ভেসে উঠল সমুদ্রের তটভূমিতে। শেলীর পকেটে তখনও ছিল সফোক্লিস ও কীটসের কবিতার বই।
শেলীর কাব্যজীন
শেলীর কবি জীবনকে দুটি অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম অধ্যায়ের মধ্যে ফুটে উঠেছে তারুণ্যের স্বভাবধর্ম। তিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। সেদিন শেলীর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল “ ভাঙ্গ , ভাঙ্গ কারা , আঘাতে আঘাত করো”।
সৃষ্টিকর্তার নামে যাজক সম্প্রদায়ের ভণ্ডামিকে তিনি সহ্য করতে পারেননি। শুধু যাজন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেননি, খোদ স্রষ্টার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেছেন। এই বিদ্রোহের রাঘামশালের আগুনে প্রাণহীন জীর্ণ সমাজের বুকে আগুন লাগাতে চেয়েছেন, নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছেন পশ্চিমাঝড়ের তাণ্ডব নৃত্যে সব কিছুকে ভেঙেচুরে দিয়ে।
শেলী ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের সমর্থক, রুশো প্রবর্তিত আদর্শের পূজারি। কিন্তু শেষ অধ্যায়ে শেলীর জীবনের ভাবনা ভিন্নপথে পরিবর্তিত হয়েছে । প্রথমত, গডউইন পরিবারের প্রভাবের ফলে শেলীর তরুণ বয়সের বিশ্বাসের মূলে দোলা লেগেছে। দ্বিতীয়ত, ইতালির হৃদয়হরণকারী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সুনীল আকাশের রৌদ্রকরোজ্জ্বলতা, পাইন সমাচ্ছন্ন অরণ্যের সবুজ ঔজ্জ্বল্য কবিকে মুগ্ধ করেছিল। প্লেটোর দার্শনিক মতবাদ সেদিন কবি চিত্তকে অধিকার করেছিল। এর ফলে কবির কাছে ফরাসি বিপ্লবের বাণী ও রুশোর আদর্শ যা একান্তভাবে সত্য ছিল তা মিথ্যায় পরিণত হলো। যে জীবনকে তিনি সমাজের মৃত্তিকায় বিকশিত হতে দেখেছিলেন, মানুষের প্রতি সুগভীর প্রেম নিয়ে ,আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে যে জীবনকে তিনি দেখেছিলেন, সংশয়হীনচিত্তে যে জীবনের স্বরূপকে আরতি করেছেন, সেই জীবন ও জগৎকে ত্যাগ করে তিনি আধ্যাত্মিক চেতনার তরণীতে চেপে আত্মার রহস্য – সন্ধানে অনির্দেশ্য লোকে যাত্রা শুরু করলেন । তাঁর কাছে মনে হলো , জীবন রহস্যময় । আত্মার অমরত্বের সন্ধানে যাত্রা করে তিনি উপলব্ধি করলেন যে , “ The one remains , the many change and pass . ” তিনি জানতে পারলেন , যে আত্মা পরমাত্মার অংশ বিশেষ । জাগতিক বন্ধনের মধ্যেই তার মহিমা ক্ষুণ্ন হয় । মৃত্যুর পর সেই আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে হয় মহিমান্বিত । তবু কুহেলিকার পর্দাখানা ছিঁড়ে ফেলে সত্যের অখণ্ড মূর্তি দেখবার জন্যে তাঁর একটা ব্যাকুলতা ছিল । সেই ব্যাকুলতর জিজ্ঞাসার আকুলতর আর্তি হলো , “ Then , what is life?”
নিসর্গ প্রকৃতি শেলীর কাছে সান্ত্বনার স্থল , বেদনার প্রলেপ, প্রেরণার উৎস দুঃখরাতের তারা। তবুও শেলীর মন রোমান্টিক বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন। কী যেন চেয়েছেন। অথচ পাননি । এই না পাওয়ার বেদনাই কবিকে করেছে পীড়িত, রক্তাক্ত। অথচ যা পেয়েছেন তা তিনি চাননি। হয়তো অনেক কিছুই চেয়েছেন যা পাওয়া সম্ভব ছিল না। শেলীর কামনার অতৃপ্তির ব্যাকুল বাঁশরি বিশ্বজগৎকে বেদনায় মুহ্যমান করে দেয় যখন তিনি ক্ষোভের সঙ্গে উচ্চারণ করেন:-
Move my faint heart with grief , but with delight No more – Oh never more!
শেলী অতিমাত্রায় অতীন্দ্রিয়বাদী। সৌন্দর্যের অতীন্দ্রিয় জগতে তিনি তার আসন পেতেছেন। তাই শেলী অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য। প্রমিথিউস আনবাউন্ড হলো নাট্যগীতি। এই গীতি নাট্যটির রচনাকাল ১৮১৮-১৮১৯। শেলী তখন ইতালিতে। চিরকালের জন্য তিনি ছেড়ে চলে গেছেন ইংল্যান্ড। অথবা ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যেতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু শেলী যে অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন তাতে তিনি নিজেকে প্রমিথিউস – এর মতোই মনে করেছেন।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস(শীতল ঘোষ)