ইউরোপের ইতিহাসবিদদের মতে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪০০/১৫০০ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ প্রায় ১ হাজার বছর সময় কে মধ্যযুগ বলা হয়। এরপর ইউরোপে রেনেসাঁসের শুরু হয়। এই দীর্ঘ ১ হাজার বছর ইউরোপ পুরোপুরি অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।
মধ্যযুগের এই দীর্ঘ সময়ে পুরো ইউরোপজুড়ে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও যুদ্ধ লেগেই থাকতো। শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছুর অবস্থাই ছিলো ভয়াবহ রকমের খারাপ। এসবের সাথে প্রচলিত ছিলো অদ্ভুত সব নিয়ম, আচার ও রীতি নীতি যা আজকের সময়ে দাড়িয়ে আপনার মনে হবে অসভ্যতা ও বর্বরতা ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু তখন এসব ব্যাপারগুলো অতি সাধারণ মনে করা হতো।
এমনই কিছু অদ্ভুত প্রথা ও রীতি নীতি সম্পর্কে জানাবো এই লেখার মাধ্যমে।
নৃশংস মৃত্যুদন্ড
বর্তমানে আদালতে মানুষের অপরাধরের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদন্ড, তবে বেশিরভাগ দেশই মৃত্যুদন্ড তুলে ফেলছে। কিন্তু মধ্যযুগে অপরাধীকে অত্যাধিক যন্ত্রণা ও অত্যাচার করে শাস্তি দেওয়া হতো; আর তা খুবই স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য ছিলো। কিভাবে মৃত্যু দন্ড দেওয়া হবে ফাঁসিতে নাকি মাথা কেটে কিংবা অন্যকোনো উপায়ে শাস্তি দেওয়া হবে, সবকিছুই নির্ধারণ করা হতো অপরাধ কতটা গুরুতর সেসব দিক বিবেচনা করে। সেই সঙ্গে অপরাধীর সামাজিক অবস্থান ও বিবেচ্য বিষয় ছিল।
অপরাধীকে অত্যাচার ও নির্যাতন করে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দেওয়াকে ন্যায়বিচার এবং সম্পূর্ণ বৈধ উপায় মনে করা হতো। মধ্যযুগের ইউরোপে ভয়ংকর সব অত্যাচারের মধ্যে ছিল: ব্রেকিং হুইল, ঝুলিয়ে মৃত্যু, ভারী বস্তু দিয়ে পিষে হত্যা করা, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, গরম জলে সিদ্ধ, কুঠার বা তরবারি দিয়ে শিরশ্ছেদ ও বহু ধরনের উপায়ে মৃত্যু দেওয়া হতো।
পশুদের আদালতে বিচার করা হতো
মধ্যযুগের ইউরোপে আদালতে শুধু মানুষ নয় পশুদেরকেও বিচার করা হতো। এটা শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও সত্যি। এডমন্ড পি. ইভান্সের “দ্য ক্রিমিনাল প্রসিকিউশন অ্যান্ড ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট অফ অ্যানিম্যালস” বইতে লেখক লিখেছেন কিভাবে, অর্ধ সহস্রাব্দেরও কম আগে, প্রাণীদের বিচার করা হয়েছিল, উপহাস করা হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং নির্বাসিত করা হয়েছিল। বেশ কিছু নথিপত্র ঘাটাঘাটি করে দেখা যায় কমপক্ষে ৮৫ টি প্রাণীর বিচার করা হয়েছিলো মধ্যযুগের ইউরোপে।
তবে এরমধ্যে আদালতে শূকরে বিচার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৪৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে লেভেগনি (সুইজারল্যান্ডের একটি পৌরসভা) তে মধ্যযুগের সবচেয়ে বিচিত্র বিচারের ঘটনাটি ঘটেছিল। বিচারের জন্য আদালতে ৬ টি শূকর কে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। এই শূকরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো এরা ৫ বছরের একটি শিশুকে হত্যা করেছে এবং হত্যার শেষে খেয়ে ফেলেছে।
বিচার চলাকালীন, নয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন, এবং উভয় পক্ষের আইনজীবীরা প্রতিনিধিত্ব করেন। সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন শেষে বিচারক তার সাজা ঘোষণা করেন।
শূকরের মালিক, জেহান বেলি, অবহেলার জন্য অভিযুক্ত হয়েছিল কিন্তু কোন শাস্তি পায়নি। ছয়টি শূকরকে খালাস দেওয়া হয়েছিল, এবং বিচারক নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ-
যেহেতু বাচ্চা শূকরদের কেও রক্তমাখা অবস্থায় পাওয়া গেছে তাই তারা ছিলো তার মায়ের সহযোগী। যেহেতু তারা ছোট তাই এই কাজে তারা তাদের মা শূকরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তাই বাচ্চা শূকরদের কে তার মালিকের হেফাজতে পাঠানো হয়েছিল।
আর শিশু হত্যার জন্য মূল আসামি হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করে মা শূকর কে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। বিচারক আদেশ দেন শূকরের পায়ে দড়ি বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হোক।
এছাড়াও মধ্যযুগের ইউরোপের আদালতে কুকুর সহ বিভিন্ন প্রাণীর বিচার হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি ১৪৭৮ সালে সুইজারল্যান্ডের আদালত পোকামাকড়দের বিচার করা হয়েছিল!
জার্মানির মধ্যযুগের অদ্ভুত বিচার ব্যাবস্থা
জার্মানিতে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝামেলা বাধলে সেটা আইনগতভাবেই মারামারি করে সমাধানের উপায় ছিল! এ জন্য অবশ্য কিছু নিয়ম কানুন ছিল। যেমন- প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষেরা নারীদের থেকে বেশি শক্তিশালী। তাই এমন অবস্থায় মারামারিতে ছেড়ে দিলে স্বামীদের জেতার সম্ভাবনাই যে অনেক বেড়ে যাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই সমস্যা দূরীকরণে স্বামীকে একটি গর্তে আবদ্ধ রাখার পাশাপাশি তার একটি হাতও পেছনের দিকে বেধে রাখা হতো। ফলে তাকে লড়তে হতো একহাতে, একস্থানে থেকেই। ওদিকে স্ত্রী থাকতো মুক্ত। দুজনের হাতেই দেয়া হতো দুটো মুগুর।
লড়াইয়ে স্বামী হেরে গেলে তাকে জনসাধারণের সামনে প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হতো। আর যদি স্ত্রী হেরে যেতো তখন তাকে স্বামীর গর্তে পাঠিয়ে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো।
লোমহীন মুখ
বর্তমান সময়ে মহিলারা যেখানে নিজেদের চেহারা আরো সুশ্রী করতে চোখের ভ্রুর বিভিন্ন রকম ডিজাইন ও যত্ন নেয়। মধ্যযুগের নারীরা ছিলো তার একেবারেই উল্টো। মার্গারেট শাউস তার বই Women and Gender in Medieval Europe an Encyclopedia বইতে মধ্যযুগের নারীদের এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছেন।
তিনি বলেছেন যেহেতু কপাল ছিলো মুখের কেন্দ্র বিন্দু তাই মহিলারা তাদের চোখের পাপড়ি ও ভ্রু কেটে ফেলতো। এসব ভ্রু ও পাপড়ির চুলকে অবাঞ্ছিত ও অপ্রয়োজনীয় মনে করতো তারা। অনেক নারী আবার নিজেদের মাথা একেবারেই টাক করে ফেলতেন। যেনো তাকে ডিম্বাকৃতির মতো দেখায়।
রোগ নিরাময়ে শরীর থেকে রক্তপাত করানো হতো
মধ্যযুগের ইউরোপের চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলো ভয়াবহ করমের দূর্বল ও খারাপ। চিকিৎসকরা প্রায়শই গলা ব্যথা থেকে শুরু করে প্লেগ রোগের চিকিৎসা করার জন্য শরীর থেকে রক্ত নিষ্কাশনের পরামর্শ দিতেন। তারা বিশ্বাস করতো যে বেশিরভাগ অসুস্থতা ‘খারাপ রক্ত’ থেকে হয়। আর তাই রোগীকে সুস্থ করার জন্য শরীর থেকে সেই খারাপ রক্ত বের করে দেওয়া দরকার। প্রথাটি প্রাচীন সুমেরীয় এবং মিশরীয়দের মধ্যে উদ্ভূত হলেও মধ্যযুগের ইউরোপে বহুল প্রচলিত ছিল।
রক্তপাত করানোর জন্য রোগীদের ধমনীকে সামান্য কেটে তা দিয়ে রক্ত বের করানো হতো। রক্ত বের করানোর জন্য ব্লেড ও বিশেষ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হতো।১১৬৩ সালে সন্ন্যাসী ও চিকিৎসকদের এমন অদ্ভুত চিকিৎসা পদ্ধতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। কারন বহু মানুষ অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়ার ফলে মারা গিয়েছিল।
এই চিকিৎসা পদ্ধতির ফলে নাপিতরাও চিকিৎসা সেবা দিতে শুরু করেছিলো। তারা রোগিদের হাত ব্লেগ দিয়ে কেটে রক্তপাত করাতো। সে সময়ে ইউরোপে নাপিতের চাহিদাও বেশ বেড়ে গিয়েছিল।
বোকাদের উৎসব
এই উৎসবটি জানুয়ারির ১ তারিখ বা মসের শুরুর যেকোনো দিনে অনুষ্ঠিত হতো। বিশেষ করে মধ্যযুগের ইউরোপের ফ্রান্সে এই উৎসব পালিত হতো। উৎসবে একজন ভন্ড পোপ বা বিশপ নির্বাচন করে গির্জার নকল আচার অনুষ্ঠান আয়েজন করা হতো, এবং নিম্ন ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা একে অপরের সাথে স্থান পরিবর্তন করতো; এই কার্যক্রমগুলি বাইবেলের নীতি উদযাপনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছি। বাইবেলে বলা হয়েছে
পৃথিবীতে যা মূর্খ তা ঈশ্বরই বেছে নিয়েছেন জ্ঞানীদের লজ্জিত করার জন্য। ঈশ্বর জগতের দুর্বল বিষয় সকল মনোনীত করলেন যাতে ঐগুলি বলবানদের লজ্জা দেয়৷
১ করিন্থীয়:২৭
এছাড়াও কিছু পৌত্তলিক আচার ও সংযোজিত করা হয়েছিলো এই উৎসবে। এই উৎসব ১৩ শতকের ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্মের নৈতিকতা উপহাসে পরিণত হয়েছিল। ১৪৩১ সালে বাসেল কাউন্সিল দ্বারা বারবার নিষেধাজ্ঞা এবং জরিমানা জারি করা সত্ত্বেও ১৬ শতক পর্যন্ত এই উৎসব চলমান ছিল।
উৎসব চলাকালীন, অভিনয়শিল্পীরা মুখোশ এবং মহিলাদের পোশাক পরতো, অশ্লীল স্তবগান গাইতো, মাতাল হতো, গীর্জার মধ্যে গিয়ে লাফালাফি করতো, প্রার্থনায় ‘আমেন’-এর পরিবর্তে ‘হি-হাউ’ দিয়ে বলা হতো। এছাড়াও পোপ ও গীর্জাকে উপহাস করা হতো।
একটি সুন্দর মৃত্যু
মধ্যযুগে প্লেগের মতো ভয়াবহ সব মহামারি এসেছিল। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ মানুষ মারা গেছে। তবে মৃত্যু নিয়ে মধ্যযুগের মানুষদের নিয়ে ফ্যান্টাসিও লক্ষ করা যায়। সবাই চাইতো তার মৃত্যু যেনো সুন্দর হয়। আর এটাই এক ধরনের ফ্যাশনে পরিনত হয়েছিল। যা পরবর্তীতে “আরস মোরিন্দি” বা “মৃত্যুর শিল্প” নামে ফ্যাশনের সৃষ্টি হয়েছিল।
মৃত্যু হওয়া উচিত পরিকল্পিত ও শান্তিপূর্ণভাবে। একজন ভালো খ্রিস্টানের মৃত্যু এভাবেই হওয়া উচিত। মৃত ব্যক্তির উচিত, খ্রীষ্টের মতো, হতাশা, অবিশ্বাস, অধৈর্য, গর্ব বা লোভ ছাড়াই তাদের ভাগ্যকে গ্রহণ করা। এমন ধ্যান ধারনা মধ্যযুগের ইউরোপে একপ্রকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। সে সময়ে গীর্জার যাজকদের সাথে খাবারে টেবিলে খাবার খেয়ে মৃত্যু হওয়া ছিলো জনপ্রিয় মাধ্যম। মৃত ব্যক্তি এই নৃশংস হত্যাকান্ডকে শান্ত ও প্রশান্তির সাথে মেনে নিয়েছিল।