You are currently viewing হাচিকো: এক বিশ্বস্ত কুকুরের গল্প

হাচিকো: এক বিশ্বস্ত কুকুরের গল্প

কুকুরের প্রভুভক্তির কথা আমরা সবাই জানি। মানুষ যখন গুহায় থাকত, শিকার করে খাবার সংগ্রহ করত, তখন থেকেই এই বন্ধুত্বের শুরু (বলা হয় কুকুর মানুষের ইতিহাসের প্রথম পোষা প্রাণী)।
কুকুর মানু্ষকে সাহায্য করত, সঙ্গ দিত, আবার শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষাও করত। কুকুর হচ্ছে প্রথম প্রাণী, যাকে মানুষ পোষ মানায়। কিন্তু জাপানের হাচিকো কেবল পোষ্য নয়, হয়ে উঠেছিল সত্যিকারের বন্ধু।

যাকে নিয়ে আজকে গল্প তার নাম ইজাবুরো উনো। তিনি জাপানের শিবুয়া এলাকায় থাকতেন।

১৯২০ সালের কথা, ইজাবুরো ছিলেন টোকিও ইউনিভার্সিটির কৃষি বিভাগের একজন নামকরা প্রফেসর। তার আদরের কুকুরটি ছিলো তার নিত্যসঙ্গী, আকিতাইনু প্রজাতির এই পশমী কুকুরটির নাম ছিল হাচিকো। আদর করে তাকে হাচি বলেও ডাকতেন তিনি।

ইজাবুরোর প্রতিদিনের রুটিন প্রায় একইরকম। সকালবেলা হাচিকোকে সাথে নিয়ে শিবুয়া স্টেশনে আসতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য ট্রেনে উঠতেন হাচিকে বিদায় দিয়ে। লেকচার শেষ করে বিকাল ৩টার সময় তিনি আবার ফিরে আসতেন শিবুয়া স্টেশনে, যেখানে হাচি তার জন্য অপেক্ষা করতো।

এরপর দুজনে মিলে হেঁটে সেখান থেকে বাড়ি ফিরতেন। হাচির ছোট্ট পৃথিবীতে এই সময়গুলোই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান। হাচিকো বাকি জীবনটা এভাবেই হয়তো কাটিয়ে দিতে পারত, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না।

১৯২৫ সালের মে মাসের ৩১ তারিখে ইজাবুরো যখন ক্লাসে লেকচার দিচ্ছিলেন, সেই অবস্থাতেই তার হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়। পরবর্তীতে হাসপাতালে নেবার পর সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এদিকে বিকাল ৩টায় হাচিকো উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করে রইলো মনিবের জন্য, কিন্তু কেউ এলো না।বিশ্বস্ত হাচিকো পরেরদিন ঠিক ৩টা বাজে শিবুয়া স্টেশনে গিয়ে একই জায়গায় বসে রইল।

ভাবখানা এমন, ইজাবুরো এখনই ট্রেন থেকে নেমে তাকে কোলে তুলে নেবে আর সে লেজ নেড়ে তাকে সম্ভাষণ জানাবে। কিন্তু প্রিয় মনিব আজও এলো না। হাচি হাল ছেড়ে দিল না।

আরো পড়ুন:  মাথা ছাড়াই ১.৫ বছর জীবিত ছিলো মুরগীটি

পরেরদিন হাচিকে আবারও একই জায়গায় একই সময়ে বহাল তবিয়তে দেখা গেল। এভাবে দিনের পর দিন ধরে সে স্টেশনে এসে বসে থাকতে লাগল। খুব অল্পদিনের মধ্যেই হাচিকোকে আশেপাশের সবাই চিনে ফেলল।

প্রফেসর ইজাবুরোর ছাত্রদের কানে এই ঘটনাটি গেলো। একদিন তার একজন ছাত্র ট্রেনে চেপে শিবুয়া স্টেশনে হাচিকোকে দেখতে এলো। সেখানে ছোট্ট হাচিকোকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। ফিরে গিয়ে সে দৈনিক একটি পত্রিকায় হাচিকোর এই প্রভুভক্ততা নিয়ে কলাম ছেপে দিল, এতে সমগ্র পৃথিবী হাচিকোর কথা জেনে গেল।

বিশ্বস্ততা আর বন্ধুবাৎসল্যের প্রতীক হিসেবে সবাই হাচির উদাহরণ দিতে লাগলো। বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন হাচিকোকে একনজর দেখার জন্য জাপানে আসতে লাগলো।টানা ১০ বছর ধরে ঝড়-বৃষ্টি, ঠান্ডা কোনো কিছুই হাচিকোকে রুখতে পারেনি, প্রতিদিনই সে স্টেশনে হাজির হতে লাগলো।

এমনকি বার্ধক্য আর আর্থ্রাইটিসকেও সে পাত্তা দেয়নি। তার মনে কেবল একটাই আশা, কোনো একদিন নিশ্চয়ই সে মনিবকে দেখতে পাবে, অন্তত একবারের জন্য হলেও। মাঝে মাঝে দলবেঁধে এলাকার লোকজন তার সঙ্গে করে আসতো, কখনও সে একাই আসতো।

অবশেষে ১৯৩৫ সালের এক শীতল সন্ধ্যায় হাচিকো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, প্রাকৃতিকভাবেই। তার মৃতদেহ শহরের লোকজন রাস্তায় আবিষ্কার করলো। সবাই গভীর আলিঙ্গনে তাকে বুকে তুলে নিল, তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করলো ইজাবুরোর কবরের পাশেই। ১০ বছর পর প্রিয় মনিবের সঙ্গ পেয়ে হাচিকোর কেমন লাগছিল, তা জানার উপায় আর কারোই রইল না।

হাচিকো সমস্ত বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল, তার মৃত্যুতে কেঁদেছিল হাজারো মানুষ। তার স্মরণে শহরবাসী একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি তৈরি করে ঠিক সেই জায়গাটায়, যেখানে সে মনিবের জন্যে প্রতিদিন অপেক্ষা করতো। এছাড়া তাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি সিনেমাও, নাম ‘হাচিকো: এ ডগ’স টেল’, যা অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

Leave a Reply