You are currently viewing ইতিহাসের ৫ জন নিষ্ঠুরতম সম্রাট

ইতিহাসের ৫ জন নিষ্ঠুরতম সম্রাট

ইতিহাসের পাতায় যেমন অসংখ্য ভালো ও প্রজা দয়ালু শাসক ছিলেন; তেমনই অসংখ্য খারাপ রাজাও রয়েছেন। সেসব নিষ্ঠুর শাসকদের নিষ্ঠুরতা এতোটাই ভয়াবহ ছিলো যে এখনো তাদের নিষ্ঠুরতার কথা শুনলে আপনার গা শিউরে উঠবে।

চেঙ্গিস খান

চেঙ্গিস খান ছিলেন মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার সাম্রাজ্যকে এতোটাই বিস্তার করেছিলেন, যে সে সময় তা হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। আয়তনে তা ছিল পৃথিবীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ।

চেঙ্গিস খানের নিষ্ঠুতা তার শৈশব থেকেই লক্ষ করা যায়। চেঙ্গিস খানের বয়স যখন মাত্র ১০ বছর, তখন তিনি তার ভাইকে হত্যা করেছিলেন। তার ভাইয়ের অপরাধ ছিলো সে চেঙ্গিস খানের মাছ চুরি করেছিল।

চেঙ্গিস খান Image Courtesy: Pintarest

চেঙ্গিস খান তার ২১ বছরে শাসনামলে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল দখল করতে গিয়ে তিনি ও তার সেনাবাহিনী প্রায় ৪০ মিলিয়নের অধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। তার এতো এতো মানুষ হত্যার ফলে অসংখ্য শহর ও জনবহুল এলাকা মানবশূণ্য হয়ে পড়ে। আর সেসব জনমানবশূণ্য এলাকা ক্রমে ক্রমে গাছপালায় বনজঙ্গলে পরিণত হয়। আর এই সৃষ্টি হওয়া বিশাল বনজঙ্গলের গাছপালা বায়ুমণ্ডল থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়। বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন চেঙ্গিস খানের কারনে বায়ুমন্ডল থেকে ৭০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডল থেকে অপসারিত হয়েছিল

সম্রাট ক্যালিগুলা

সম্রাট ক্যালিগুলা ৩৭ খ্রিস্টাব্দে তার চাচার মৃত্যুর পর রোমান সাম্রাজ্যের নতুন সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে বসেন(তবে এই মৃত্যু নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে সংশয় আছে, অনেকেরই ধারণা ক্যালিগুলাই তার চাচা কে খুন করেছে সিংহাসনে বসার জন্য)

ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মাথায় হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ঠিক যেমন তার চাচা টাইবেরিয়াস মরার আগে অসুস্থ হয়েছিলেন। সবাই ভাবলো এযাত্রায় বুঝি আর রক্ষা নেই। তারা সম্রাটের উত্তরসূরি গেমেলাসকে মানসিকভাবে সম্রাট হওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে লাগলেন। কিন্তু এক মাসের পর ক্যালিগুলা সুস্থ হয়ে উঠলেন। যেন ‘পুনর্জন্ম’ হলো সম্রাটের। অবশ্য এই পুনর্জন্ম শুভ হলো না তার জন্য। তিনি যেন এক ভিন্ন ক্যালিগুলায় রূপান্তরিত হলেন।

সুস্থ হওয়ার পর তিনি নারী সঙ্গে উন্মত্ত হয়ে উঠেন। তিনি তার শয্যাসঙ্গের জন্য হাজার হাজার নারী দাসী প্রাসাদে আনেন। এতেও তার স্বাদ মেটেনি তার এবার চোখ পড়ে শহরের সিনেটরদের স্ত্রী ও মেয়েদের প্রতি। জোড় করে সম্রাট শহরের সিনেটদের স্ত্রী ও মেয়েদের নিজের যৌনদাসী বানান।

সম্রাট কেবল এখানেই থেমে থাকে নি। নিজের সিংহাসনকে সুরক্ষা করতে নিজের প্রতিপক্ষ সকলকে মৃত্যুদন্ড দেন, তার মধ্যে তার উত্তরসূরী গোমেলাস ও ছিল।

আরো পড়ুন:  ইতিহাসের বিভিন্ন যুদ্ধের কিছু হাস্যরসাত্মক ঘটনা

ক্যালিগুলা উচ্চ বিলাসী জীবন যাপন করতেন। তার জন্য প্রয়োজন পড়তো প্রচুর পরিমানে অর্থের। তার জন্য তার রক্ষীরা লোকেদের থেকে জোর করে অর্থ লুট করতো। তার সাথে আরোপ করতো কয়েকগুণ বেশি কর।

ক্যালিগুলার এমন নির্মম শাসন রোমবাসীদের বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি। শাসনের মাত্র ৪ বছরের মাথায় তার পতন হয়। ৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি একটি খেলার অনুষ্ঠানে একজন দেহরক্ষী প্রথম ক্যালিগুলাকে ছুরিকাঘাত করে বসে। এরপর মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন প্রিটোরিয়ান রক্ষী ক্যালিগুলাকে ঘিরে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। ইতিহাসবিদদের মতে, মোট ৩০ বার তাকে ছুরিকাঘাত করার মাধ্যমে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুর পর রোমবাসী আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। শোনা যায় পুরো শহরের মানুষ সেদিন পানীয় পান করে তার মৃত্যু উৎসব করেছিল।

ভ্লাদ দ্য ইম্পেরাল

ব্রাম স্টোকারের বিখ্যাত ড্রাকুলা চরিত্রটি ভ্লাদ কে কল্পনা করেই সৃষ্টি করেছিলেন। ভ্লাদ ছিলেন ওয়ালাচিয়া সাম্রাজ্যের যুবরাজ ( বর্তমানে সেটি আধুনিক রোমানিয়া)।

ভ্লাদ ১৪৫৬ থেকে ১৪৬২ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। তার অত্যধিক নিষ্ঠুর শাস্তি গুলোর মধ্যে ছিল জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা, অঙ্গ আলাদা করে ফেলা, কাঠের তীক্ষ্ণ ফলার উপর বসিয়ে হত্যা করা, তীক্ষ্ন সরু বস্তু মলদার দিয়ে প্রবেশ করানো, চামড়া তুলে ফেলা, জীবন্ত কবর দেওয়া। এছাড়াও ভ্লাদ যেসব লোকেদের পছন্দ করতেন না তাদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলতেন।

ভ্লাদ কে নিয়ে প্রচলিত গল্প আছে যে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদকে কর দিতে অস্বীকার করেছিলেন। এছাড়াও প্রচলিত আছে যে ভ্লাদ বুলগেরিয়া আক্রমণ করেছিলেন এবং ২৩ হাজারের অধিক তুর্কি সৈন্য হত্যা করেছিলেন।

Image: Wikimedia Commons

সুলতান মেহমেদ ওয়ালাচিয়া জয় করার জন্য একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। কিন্তু ভ্লাদের বাহিনী রাতের বেলা সুলতানের বাহিনীকে আক্রমণ করে অনেক সৈন্য হত্যা করে। সুলতান মেহমেদ ক্ষুদ্ধ হয়ে ওয়ালাচিয়ার রাজধানী টার্গোভিস্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু যাত্রা পথে ২০ হাজারের অধিক তুর্কি সৈন্যের কঙ্কালের জঙ্গল আবিষ্কার করে আতঙ্কিত হয়ে সুলতান ও তার সৈন্যরা পালিয়ে যান।
অনুমান করা হয় যে ভ্লাদ তার জীবদ্দশায় ৪০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন।

অটোমান সুলতান ইব্রাহিম

সুলতান ইব্রাহিম তার রাজত্বের সময় তার প্রজাদের কাছে পাগল ইব্রাহিম নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৬৪০ সালে ইব্রাহিমের বড় ভাই সিরোসিসের মৃত্যুর পর ইব্রাহীম অটোমান সাম্রাজ্যের শাসক হন।

ভাইয়ের শাসনামলের সময় ইব্রাহিমের বাহিরের পৃথিবীর সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না। তিনি উসমানীয় প্রাসাদের একটি এলাকা কাফেসের অভ্যন্তরে চার বছর কাটিয়েছেন। সেখানে সিংহাসনে উত্তরাধিকারীদের সিরোসিস দীর্ঘ ৪ বছর তালাবদ্ধ করে রেখেছিল।

আরো পড়ুন:  মানব ইতিহাসের নৃশংস শাস্তি: অতীতের চারটি বিভীষিকাময় অধ্যায়

মনে করা হয় বাহিরের পৃথিবীর সাথে দীর্ঘ দিনের বিচ্ছিন্নতা ইব্রাহিমের মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করেছিল।

সিংহাসনে বসার উপর ইব্রাহিম উদ্ভট সব বিলাসিতায় মেতে উঠেছিলেন। তিনি তার দাড়িকে হীরা দিয়ে সাজিয়ে ছিলেন। রাজপ্রাসাদের সকল পর্দাকে তিনি এক বিরল পারফিউম দিয়ে সুগন্ধি করে রাখতেন। ইব্রাহিম বেড়াল পুষতে পছন্দ করতেন, সেই বেড়ালগুলোকে রাখতে তিনি দামী পশমের কাপড় ব্যবহার করতেন।

সুলতান ইব্রাহিম Image Credit: Google web

তবে এসব কিছুই তার সিংহাসন ও সাম্রাজ্যের জন্য খুব একটা হুমকির কারণ ছিলো না। ইব্রাহিমের নারী লালসা ছিলো তার সবচেয়ে বড় পাপ। সে অগণিত মহিলাকে তার শয্যাসঙ্গী করেছিল। বিশেষত কুমারী নারীদের প্রতি তার একধরনের ঝোঁক তৈরি হয়েছিল।

ইব্রাহিম তার সেইসব পত্নী বা যৌনদাসী যাই বলি না কেনো; কারো সাথেই সে সম্মানের সাথে আচরণ করেননি। এমনকি তিনি তার ২৮০ জন যৌনদাসীকে বস্তায় বেঁধে পানির নিচে ফেলে হত্যা করেছিলেন।

এছাড়া ইব্রাহিম তার অনেকগুলো গ্র্যান্ড ভিজিয়ারকে (সেনাবাহিনী প্রধান এমন নেতৃবৃন্দ) মৃত্যুদন্ড দেয়, নিজের ক্ষমতা সুরক্ষার জন্য। তার মনে হয়েছিল তারা যে কোনো সময় বিদ্রোহ করতে পারে। যেহেতু ইব্রাহিম উচ্চাভিলাস জীবন যাপন করতেন। তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হতো, আর তাই তিনি তার প্রজাদের উপর উচ্চ কর আরোপ করেন।

ইতিহাসের পাতায় কোনো অত্যাচারী রাজাই বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেন নি। ইব্রাহিমের ক্ষেত্রেও তা ব্যাতিক্রম হয়নি। ইব্রাহিমকে অবশেষে ১৬৪৮ সালে (শাসনের ৮ বছরের মাথায়) বন্দী করা হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

রাজা জন

রাজা জন ছিলেন রাজা দ্বিতীয় হেনরির কনিষ্ঠ ও প্রিয় সন্তান। জনের জন্মের পর তার নামে দেওয়ার মতো দেশে কোনো জমি অবশিষ্ট ছিল না! আর তাই রাজা হেনরি উপহাস করে ছেলের নাম দেন ‘জন লেকল্যান্ড’।

জন ছিরেন ধর্ম বিমুখী ও ক্ষমতার লোভী। জনের বড় ভাই রিচার্ড যখন ক্রুসেড যুদ্ধে যোগ দেয়, তখন তিনি সিংহাসন দখল করার বৃথা চেষ্টা করেন। রিচার্ড যুদ্ধ থেকে ফিরে আসলে সে সিংহাসন পুনর দখল করে জনকে নির্বাসনে পাঠান।

রাজা জান


১১৯৯ সালে রিচার্ড মারা গেলে জন আবার সিংহাসন দখল করে নেয়। রিচার্ডের ছেলে আর্থার সিংহাসন দাবি করলে জন নিজের ভাইয়ের ছেলেকে হত্যা করেন। রাজা হওয়ার পর জন ব্যারনদের উপর অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দেয়। এছাড়াও ছেলে সন্তানের আশায় তিনি অনেকগুলো বিয়ে করেন। তার শাসনামলে পুরো রাজ্য জুড়ে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। অবশেষে তিনি বিদ্রোহী ব্যারনদের দেওয়া গঠনতন্ত্রের দলিলে সই করতে বাধ্য হন ‘মেগনা কার্টা’ নামে পরিচিত।

Mehadi Bhuiyan

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.

Leave a Reply