You are currently viewing তেইকোকু ব্যাংক ডাকাতি: জাপানের ইতিহাসের রহস্যময় পুলিশ কেইস

তেইকোকু ব্যাংক ডাকাতি: জাপানের ইতিহাসের রহস্যময় পুলিশ কেইস

সময়টা ১৯৪৮ সালের ২৬ জানুয়ারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কিছুকাল পরের ঘটনা। জাপানের টোকিও শহরের ‘শিনামাচি’ এলাকার ‘তেইকোকু ব্যাংক’-এ দুপুর সাড়ে তিনটা নাগাদ দরজা ঠেলে এক ব্যক্তিপ্রবেশ করলে। লোকটির শরীরের পরিহিত পোশাক ছিলো কোট আর প্যান্ট আর হাতে একটি আর্মব্যন্ড পরিহিত ছিলো সেখানে জাপানি ভাষায় লেখাছিলো ‘স্যাটিটেশন’। লোকটি সরাসরি গিয়ে ব্যাংক ম্যানেজারের সাথে দেখা করলো। ব্যাংক ম্যানেজারকে বললো, সে একজন পাবলিক হেল্থ অফিসার। জাপানে হঠাৎ করে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় সরকারি উদ্যোগে সবাইকে ডায়েরিয়া জীবাণু নিরোধক ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে। আর এজন্য আজ ব্যাংকের সকল কর্মকর্তাকে আজ সেই ঔষধ খেতে হবে।

ব্যাংক ম্যানেজার বিনা বাক্য ব্যায়ে রাজি হয়ে গেলেন। সেই আগন্তুক স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নির্দেশে সবাই চায়ের সাথে ডায়েরিয়ার ঔষধ মিশিয়ে খেলো। ঔষধ খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাংকের সর্বমোট ১৬ জন কর্মচারীই অচেতন হয়ে পড়লো। এইবার স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বেশধারী আগুন্তক লোকটা উঠে দাঁড়ালো তার চেয়ার থেকে। পুরো ব্যাংকে তল্লাশী চালিয়ে যার কাছে যা পেলো সেই সাথে সামনে যা টাকাপয়সা পেয়েছে সব লুট করে নিলো। লোকটি সেসময় প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার ইয়েন লুট করেছিলো, সেই সময়ে ডলার হিসেবে যার মূল্য ছিলো প্রায় ২০০০ ডলার। টাকা পয়সা নিয়ে লোকটি দ্রুত ব্যাংক থেকে পালিয়ে গেলো।

ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সেসময়ে তেইকোকু ব্যাংক এর সামনের দৃশ্য

সেই ব্যাংকের ঔষধ পান করা ১৬ জন কর্মচারীদের মধ্যে ১২ জনই পরবর্তীতে বিষক্রিয়ায় মারা যায়। এ ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর পুরো জাপানেই তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কয়েক মাস কেটে গেলেও জাপানি পুলিশ কোনো ক্লুই খুঁজে পাচ্ছিলো না। পুলিশ কোনো কুলকিনারা করতে না পারায় জাপানি ইন্সপেক্টর ‘তামেগোরো ইকিই’ কে তখন অন্য সব অপরাধ তদন্ত হতে অব্যাহতি দিয়ে শুধু এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়।

অপরাধের তদন্ত

তামেগোর ইকিই তদন্ত করতে গিয়ে লক্ষ করলেন এর আগের কয়েক মাসেও এমন দুটি ঘটনা ঘটেছিলো। একইভাবে ব্যাংকে ডায়েরিয়ার ঔষধ খাবার কথা বলে সবাই কে অজ্ঞান করে ব্যাংকের টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু সেসব ঘটনার সাথে পার্থক্য হচ্ছে আগের দুটো ঘটনায় কেউ বিষক্রিয়ায় মারা যায় নি। আর সেসব টাকা লুটের অঙ্কটাও ছিলো সামান্য। ছোটখাটো ঘটনা ভেবে পুলিশও তেমন গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করেনি। আর খুব বেশি মানুষ জানেওনি এ ঘটনা সম্পর্কে। কারণ জানাজানি হলে ব্যাংকের উপর মানুষজন আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে। তামেগোর সেই দুটো কেস নিয়ে তদন্ত শুরু করলেন। একটা কেসে দেখা গেলো ঘটনার ক্রাইম সাসপেক্ট ‘জিমো ইয়াকাগুচি’ নামে একটা বিজনেস কার্ড ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে আদান-প্রদান করেছেন। কিন্তু খোঁজাখুঁজি করেও কার্ডধারী নামের সেই ব্যক্তিকে পাওয়া গেলো না, যে এই কাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে।

আরো পড়ুন:  পৃথিবীর বিখ্যাত ৪ টি কাকতালীয় ঘটনা

অন্য আরেকটি কেসে দেখা যায় শিগেরু মাতসুই নামের একটি বিজনেস কার্ড ব্যবহৃত হয়েছে। এবার দেখা গেলো এই কার্ডের নামে একজন ব্যক্তি সত্যিই আছেন। পুলিশ তাকে খুঁজে বের করে ধরে নিসে আসলো। তাকে জোর করে দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হলো। তবে শিগেরু বেশ শক্ত প্রমাণই হাজির করেছিলেন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিপক্ষে। পুলিশ তখন পুরোপুরি গোলকধাঁধাঁয় পড়ে যায়।

তবে শিগেরু একটা ক্লুও ধরিয়ে দিলেন ডিটেকটিভ তামেগোরোকে। তিনি মোট ৫৯৩ জন মানুষকে তার পর্যন্ত বিজনেস কার্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে যে কার্ডটা তার বিপক্ষে আনা হয়েছিলো প্রমাণ হিসেবে, সেরকম কার্ড তার কাছে ছিলো মাত্র ১০০টা। যেগুলোর ৯২ টা ইতোমধ্যে তিনি মানুষকে দিয়েছেন। তামেগোর সেই ৯২ জন কার্ড পাওয়া মানুষদের উপর তদন্ত শুরু করেন। এর মধ্যে ৬২টা কার্ডধারী ব্যক্তিকে যথাযোগ্য প্রমাণের অভাবে বাদ দিয়ে দিলেন। আরো ২২ জনের মামলার সাথে কোনো যোগসূত্রই খুঁজে পেলেন না। বাকি ৮টা কার্ডধারীকে ঢুকালেন সন্দেহভাজনদের তালিকায়। অবশেষে বহু তদন্তের পরে পেলেন একটা নাম। তিনি ‘সাদামিচি হিরাসাওয়া’!

আদালতে সাদামিচি হিরাসাওয়া

সাদামিচি হিরাসাওয়া ছিলেন একজন পেইন্টার। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, শিগেরুর দেয়া সেই কার্ডটা কোথায়, সে সেটা তখন দেখাতে পারেনি। তদন্ত করে দেখা যায় যে পরিমাণ টাকা লুটপাট হয়পছে সে পরিমাণ অর্থ তার ব্যাংক একাউন্টে রয়েছে। এছাড়াও ব্যাংকের বেঁচে যাওয়া কর্মকর্তারাও তাকে শনাক্ত করতে পেরেছিল। পুলিশি জেড়ায় একপর্যায়ে তিনি তার অপরাধের কথা স্বীকার করে নেন।

বিচার

সবকিছু প্রমাণ হওয়াতে, সাদামিচিকে কোর্টে তোলা হয়। তাকে ১২ জন মানুষ খুন করার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত। আর সেখানেই এই কেস ক্লজ করে দেয়।

কিন্তু একটা কিন্তু রয়ে গেছে

ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যায় নি। সাদামিচির ফাঁসির রায় হলেও সেটা কখনোই কার্যকর হয়নি। তার অপরাধের পক্ষে অনেক প্রমাণ পাওয়া গেলেও এর বিপক্ষে আরো শক্ত অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো।

তার ফাঁসির রায়ে স্বাক্ষর করার মতো কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। বহু বছর এই রায় কার্যকর হওয়াটা ঝুলে ছিলো। সাদামিচির পক্ষে যেসব তথ্যপ্রমাণ গিয়েছিলো..

১) সে ছিলো একজন ন্যুড পেইন্টার। অশ্লীল ছবি এঁকে তিনি সে অতিরিক্ত দু-চার পয়সা কামাতো। তার ব্যাংকে থাকা ঐ টাকা সে এভাবেই কামিয়েছিলো বলে প্রমাণ হাজির করেছিলো।

আরো পড়ুন:  পৃথিবীর বিখ্যাত ৪ টি কাকতালীয় ঘটনা

২) জেরাপর্বে সে স্বীকারোক্তি দেয়ার সময়ে প্রচণ্ড পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো। এসব বিষয়ে তখনকার সময়ে জাপানি পুলিশের কুখ্যাতি ছিলো। জেরাপর্বের ব্যাপক নির্যাতন করা হয় সাদামিচিকে। সাদামিচি পরে দাবি করেন পুলিশদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরেই তিনি মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন।

৩) অপরাধ ঘটার সময়ে ব্যাংক ও তার আশেপাশে মোট ৪০ জন মানুষ তাকে দেখেছিলো। কিন্তু পরে শনাক্তকরণের সময়ে উপস্থিত সাক্ষীদের মধ্যে মাত্র ২ জন তাকে শনাক্ত করেছিলো। বাকিরা করেনি।

কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রমাণ যেটা সাদামিচির পক্ষে গিয়েছিলো, সেটা হলো – যে বিষটা ব্যবহার করা হয়েছিলো, সেটা একটা মিলিটারি গ্রেডের সায়ানাইড। যা শুধুমাত্র আর্মির গুটিকয় ক্ষমতাধর মানুষই এটা নিজের হাতে পেতে পারে। এই একটা ব্যাপারেই সবচেয়ে বড় দ্বিধা তৈরি হয়েছিলো সবার মনে। সাদামিচি একজন দরিদ্র চিত্রশিল্পী, যে ইরোটিক ছবি এঁকে পেট চালায়। সে এই জিনিস কোত্থেকে পাবে?

এতোসব দ্বিধার মধ্যে পড়ে কোনো সরকারি কর্মকর্তাই সাদামিচির ফাঁসির চূড়ান্ত আদেশে স্বাক্ষর করেনি। একজনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এসেছে আরেকজন, তারপরে আরেকজন। কিন্তু কারোরই সাহস হয়নি এটায় সই করার। সাদামিচি তার জীবনের ৩২ বছর জেলে আটকে ছিলেন।

ডিটেকটিভ তামেগোরো পুরো একটা জীবন চেষ্টা করেছিলো এই ঘটনার সবগুলো সুতো জোড়া লাগাবার। কিছু লাগাতে পেরেছে, কিছু পারেনি। এটা তার আনসলভড কেইস হিসেবেই থেকে গিয়েছিলো রিটায়ারমেন্টের আগ পর্যন্ত। সাদামিচির ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে বেশ গণপ্রতিবাদ হয়েছিলো। বাকি যারা মনে করতো সাদামিচি দোষী, তাদের কাছে ইন্সপেক্টর তামেগোরো হয়ে উঠেছিলো হিরো।

দীর্ঘ ৩২ বছর জেল খেটে সাদামিচি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জেলেই মারা যায়। তার ছেলে ‘তাকেহিকো হিরাসাওয়া’, তার বাবার মৃত্যুর পরেও চেষ্টা করেছিলো বাবার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ থেকে সাদামিচিকে মুক্তি দিতে। পরে সেও মারা যায় ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে। তাকেহিকোর মৃত্যুর পরে জাপানি আদালত ঐ বছরেরই ডিসেম্বরে সাদামিচি কেইসটার আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘোষণা করে। আর সেই সাথে এটি হয়ে যায় জাপানের সবচেয়ে রহস্যময় অপরাধ, যে অপরাধের কুয়াশার আড়ালের পেছনে কি সত্যিই সাদিমিচি ছিলেন নাকি অন্য কেউ? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা কখনোই জানতে পারবো না।

Mehadi Bhuiyan

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics. He also tutors English. Education: National University of Bangladesh BA in English Literature

Leave a Reply