You are currently viewing ৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ: মানব ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বছর

৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ: মানব ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বছর

বিভিন্ন যুগের ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম বিতর্কের বিষয় ছিলো, মানব ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বছর কোনটি?
বেশিরভাগ ইতিহাসবিদগণই ৫৩৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। এই বছরে কেবল বিপুল পরিমাণ মানুষের মৃত্যুই হয়নি। এই বছর ভয়ংকর ভাবে মানুষের জীবনযাত্রার পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছিল।

এই আর্টিকেলে তেমন কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করবো, কেন এই বছরটি অন্য বছরের তুলনায় খারাপ এবং কেনইবা ইতিহাসবিদদের পাশাপাশি বিজ্ঞানীরাও এই ব্যপারে ভিন্নমত পোষণ করেন।

বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরা খারাপ বছরের মধ্যে ৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৪২ খ্রিস্টাব্দ এই সময়ের মধ্যবর্তী বছরগুলো উল্লেখ করেছেন। তবে ধারণা করা হয় ৫৩৬ সাল থেকেই মহাবিপর্যের শুরু হয়েছিল।, এজন্য অনেকের চোখে এই বছরটিই ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বছর

জলবায়ুর অদ্ভুত পরিবর্তন

বিজ্ঞানীদের গবেষণা তথ্যমতে ৫৩৬ সাল ছিল গত ২৩০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শীতল বছর। এই শীতলতা কেবলমাত্র একটি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না, পুরো পৃথিবী জুড়েই এই শীতের প্রভাব পড়েছিল।

সেসময়কার সমসাময়িক পণ্ডিতদের লিখে যাওয়া তথ্যমতে এটি শুধুমাত্র সবচেয়ে শীতলতম বছরই ছিলো না যা খারাপ বছরের সৃষ্টি করেছে। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো আরো বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনাও ঘটেছে।

কিছু পন্ডিত উল্লেখ করেছেন তারা সবচেয়ে কড়া গ্রীষ্মকালীন সময়ে চীনে তুষারপাত দেখেছেন। একেতো চীনা সংস্কৃতির মানুষেরা ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে অভ্যস্থ না।  আর সেই সঙ্গে জলবায়ুর অদ্ভুত পরিবর্তনের ফলে বেশিরভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। এটি কেবল চীনেই ঘটেনি, বিশ্বের আরও অনেক জায়গায় ঘটেছিল যেখানে এর আগে কখনোই তুষার পড়েনি কিন্তু এই বছরে পড়েছিল। কিছু বিজ্ঞানী যুক্তি দেন যে সূর্য সেই বছর একই স্তরের তাপ প্রদান না করার কারণে এটি হয়েছিল।

Image Credit: New jursey 101.5

বেশকিছু নথির তথ্যের রেকর্ড দেখে জানা গেছে এই সময়ে দক্ষিণ আমেরিকায় দীর্ঘ ৩ মাস ভারী বৃষ্টিপাতের পর দীর্ঘদিনের খরা শুরু হয়। ফলে অর্থনীতি ভেঙে গিয়ে খাদ্যের দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়।

বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে জলবায়ুর মধ্যে এই তীব্র পরিবর্তনগুলি শুধুমাত্র ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে নয় বরং দুর্ভিক্ষের কারণেও বিশ্বের অনেক সংস্কৃতির পতনে অবদান রেখেছে।

একাধিক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত

এই বছরে খাদ্যশস্য ধ্বংস এবং দুর্ভিক্ষের জন্য ঠান্ডার সঙ্গে আরো জড়িত ছিলো পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে একাধিক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। 

আরো পড়ুন:  সান্তা ক্লজ: সেইন্ট নিকোলাসের কিংবদন্তি থেকে আজকের জনপ্রিয় চরিত্র

একাধিক আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে পৃথিবীর অর্ধেক ধুলোয় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই অগ্নুৎ্পাতের ফলে সৃষ্ট অন্ধকারের ফলে তখন সূর্যের কিরণ পৃথিবীর মাটিতে পৌঁছাতে পারে নি। এটিও একটি বড় কারণ এই বছরটি সবচেয়ে শীতলতম বছর হওয়ার।

সেসময় পৃথিবীর প্রায় সবগুলো আগ্নেয়গিরি থেকেই তীব্র অগ্নুৎ্পাতের শুরু হয় Image Credit: ThoughtCo

খুব বেশি প্রাকৃতিক তাপ না থাকার পাশাপাশি, উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক সূর্যালোকের অভাবের কারণে কৃষি আবারও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।  শুধু কল্পনা করুন যে রাত এবং দিনের মধ্যে পার্থক্য করা যায় না কারণ এটি সর্বদা অন্ধকার ছিল। সেই সাথে অনাহার ও প্রচন্ড ঠান্ডা।

এই অন্ধকার প্রায় ১৮ মাস স্থায়ী হয়েছিল, তাই ৫৩৬ খ্রিস্টাব্দের বেশিরভাগ সময় মানুষ অন্ধকারে বসবাস করেছিল।

যদিও একাধিক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ভয়ঙ্কর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি ট্রিগারিং ফ্যাক্টর হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, এই অগ্ন্যুৎপাতগুলি প্রধানত পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে ঘটেছে, তাই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না কেন অদ্ভুত জলবায়ু পৃথিবীর অন্য অর্ধেকে ও ঘটেছে।

প্রথম বুবোনিক প্লেগ হানা দিয়েছিল এই সময়টাতেই

৫৪০ এর দশকের এই মহামারি প্লেগ রোগ (যাকে আমরা বুবনিক প্লেগ বলি) হানা দিয়েছিল। সেসময় এই প্লেগ রোগের পরিচয় ছিল জাস্টিনিয়ান প্লেগ নামে।

এই জাস্টিনিয়ান প্লেগ রোগ ৫৪১ সালে শুরু হয়েছিল এবং ৫৪৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। মহামারীটি ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস নামক একটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিল যা অগত্যা কোনো ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে সংক্রামিত হয়নি, বরং হয়েছিল ইঁদুরের দ্বারা। এই মহামারীটি দৃশ্যত মিশরে শুরু হয়েছিল এবং শস্য পরিবহনের মাধ্যমে তা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই প্লেগ মহামারী টি জাস্টিয়ান প্লেগ নাম পাওয়ার কারণ ছিল, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে এই প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ার সময়কালীন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য শাসন করতো জাস্টিনিয়ানরা। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, মহামারীটি ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং সুদূর পূর্বের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে মহামারীটি সংঘটিত হওয়ার নয় বছরে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৫০% মহামারী নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

প্লেগের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলো লক্ষকোটি মানুষ। Image Credit: History News

এই মহামারীর প্রাচীনতার কারণে, মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা নির্ভুলভাবে অনুমান করা কঠিন, তবে অনুমান করা হয় যে এই সময়ে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। 
ইতিহাসবিদরাও অনুমান করেন যে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে (৫০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ)  বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৯০ মিলিয়ন। এই হিসেবের মতে এই মহামারীতে প্রাণ হারিয়ে পৃথিবীর ৫০ শতাংশ মানুষ।

আরো পড়ুন:  পৃথিবীর বিখ্যাত ৪ টি কাকতালীয় ঘটনা

ইতিহাসবিদ রা মনে করে ৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ছিল মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় কারণ মহামারী এবং অন্যান্য ঘটনা যা বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছিল যা বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যাকে মৃত্যুর পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। যেহেতু এসবের শুরুটা হয়েছিলো ৫৩৬ সাল থেকেই তাই এই বছরকে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বছর হিসেবে ধরা হয়। 

Mehadi Bhuiyan

Mehadi Bhuiyan holds a B.A. in English Literature. He has a long-standing interest in writing, with a focus on historical and mythological themes. His work often explores the cultural and literary connections between past and present. Outside of writing, he enjoys reading across genres and is passionate about music and singing.

Leave a Reply