You are currently viewing জেমস জয়েস: ভাষা ও শব্দ শৈলির বিচিত্র ব্যবহারে যিনি ছিলে অদ্বিতীয়

জেমস জয়েস: ভাষা ও শব্দ শৈলির বিচিত্র ব্যবহারে যিনি ছিলে অদ্বিতীয়

যদি আইরিশ শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এর নাম বলা হয়, তবে অস্কার ওয়াইল্ড, উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস এর সাথে জেমস জয়েস এর নাম চলে আসবে অনায়াসে।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম স্মার্ট ও সাহসী লেখক জেমস জয়েস। তার অন্যতম সেরা সাহিত্যকর্ম ‘ইউলিসিস’ ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের সেরা রচনাগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।

প্রাথমিক জীবন

জেমস জয়েস এর সম্পূর্ণ নাম জেমস অগাস্টিন অ্যালোসিয়াস জয়েস। ১৮৮২ সালের ২ ফেব্রুয়ারী তে তিনি আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

জেমস জয়েস তার বাবা মায়ের ১০ সন্তানদের মধ্যে সবার বড়।মাত্র ছয় বছর বয়সে তাকে পড়াশোনার জন্য ‘ক্লোংওয়েস উড কলেজে’ পাঠানো হয়েছিল। এই স্কুল টি ‘আয়ারল্যান্ডের ইটন’ নামে বহুল পরিচিত। জয়েস সেখানে বেশিদিন পড়াশোনা করতে পারেন নি। কারণ তার বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারা বাবা ছিলেন খুবই মাদকাসক্ত। তার সকল অর্থ তিনি পানাহারেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর পানাহার করে করেছিলেন প্রচুর ধার দেনা। জেমস জয়েস এরপরের ২ বছর আর স্কুলে যেতে পারেন নি অর্থের অভাবে। ২ বছর বাড়িতে থেকে নিজে নিজের পড়াশোনা চালিয়েছেন। ১৮৯৩ সালের এপ্রিল মাসে জেমস জয়েস এবং তার ভাই স্ট্যানিস্লাউসকে ডাবলিনের একটি জেসুইট গ্রামার স্কুলে কোনো প্রকার ফি ছাড়াই ভর্তি হন, সেখানে তিনি বেশ ভালোই ফলাফল করেন।

জেমস জয়েস যখন শিশু Credit: 24 celebs. Com



জেমস ডাবলিনের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন, বিশ্ববিদ্যালয় টি তখন জেসুইট যাজকদের দ্বারা পরিচালিত হতো। সেখানে তিনি ভাষার উপর অধ্যায়ন শুরু করেন। পাঠ্যক্রম বর্হিভূত ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে ও পড়াশোনা করতে থাকেন। জেমস জয়েস নরওয়েজিয়ান লেখক হেনরিক ইবসেনের লেখা পড়ে এতোটাই মুগ্ধ হন যে, নরওয়েজিয়ান ভাষায় ইবজেনের লেখার স্বাদ নিতে তিনি নরওয়েজিয়ান ভাষাও শিখে ফেলেন।

জেমস জয়েস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ল্যাটিনে দ্বিতীয়-শ্রেণীর সম্মান’ সহ ম্যাট্রিকুলেশন এবং বিএ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।

Credit : 24 celebs. Com

জয়েসের সাহিত্যে পথচলা

ডাবলিনের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়াকালীন সময়েই জয়েস বুক রিভিউ, ছোট গল্প ও কবিতা চর্চা শুরু করেন। একটা সময়ে এসে বুঝতে পারেন এসব সাহিত্য রচনা করে তার পেট চলবে না। তিনি চিকিৎসাবিদ্যা অর্জনের দিকে আগ্রহ দেখান। আর তাই তিনি প্রচুর ধারদেনা করে প্যারিসে যান চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে। কিছুদিন যাওয়ার পর জয়েস বুঝলেন ওসব তার দ্বারা হবে না, তিনি চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।

ফ্রান্সে গিয়ে চিকিৎসা বিদ্যা অর্জন তো হলোই না উল্টো জেমস লাইব্রেরিমুখো জয়েস হয়ে গেলেন লাইব্রেরি বিমুখী আর সমান তালে যাতায়াত করলেন পানশালায় ও পতিতালয়ে।

আরো পড়ুন:  রাণী প্রথম এলিজাবেথ সম্পর্কে ৬ টি চমকপ্রদ তথ্য

জয়েসের জীবনে প্রেমের বসন্ত এলো

জেমস জয়েস ১৯০৪ সালে হঠাৎই নোরা বার্নাকেলের প্রেমে পড়ে যান। নোরা বার্নাকেল অশিক্ষিত হলেও ছিলেন অত্যন্ত আবেদনময়ী নারী।

জেমস জয়েস তার পত্নীকে নিয়ে লিখেছিলেন:-

Electric blue eyes, yachting cap and plimsolls. But when he spoke, well then, I knew him at once for just another worthless Dublin boaster trying to chat up a country girl.

প্রারম্ভিক জীবন ও কাজ

জয়েস অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পোলায় (বর্তমানে পুলা, ক্রোয়েশিয়া) বার্লিটজ স্কুলে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন এবং অবসর সময়ে তার উপন্যাস এবং ছোট গল্পে কাজ করেন। ১৯০৫ সালে তারা ট্রিয়েস্টে চলে যান, যেখানে জেমসের ভাই স্ট্যানিস্লাউস ও তাদের সাথে যোগ দেন। আর সেখানেই তাদের ২ সন্তান জর্জিও এবং লুসিয়া জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৬-১৯০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। এই ভবঘুরে জীবন কে তিনি খুবই অপছন্দ করতেন, তার কাছে তখন মনে হতো ডাবলিনের দিনগুলোই এর চেয়ে বড় সুন্দর ছিল।

জেমস জয়েস তার মাতৃভূমি ডাবলিন কে প্রচন্ড ঘৃণা করতেন আবার প্রচন্ড ভালোবাসতেন। ঘৃণা করার অন্যতম কারণ ছিল, ডাবলিন ছিলো তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিনে, এটা তিনি কখনোই মন থেকে মানতে পারতেন না। ছোটবেলা থেকেই তিনি সবসময় একটা স্বাধীন ও সুন্দর ডাবলিন শহরের স্বপ্ন দেখতেন।

স্ত্রী ও দুই সন্তানের সাথে জয়েস Credit: Wikipedia

জেমস জয়েসের সাফল্য

বিভিন্ন দেশে ভবঘুরের মতো ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে ১৯১৪ সালে জেমস জয়েসের জীবনে আসে তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। ২২ বার নাকচ হওয়া ছোটগল্পের বইটি ছাপাতে রাজি হন লন্ডনের এক প্রকাশক। পরবর্তীতে মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড তার বিখ্যাত উপন্যাস ’A Portrait of the Artist’এর সম্পাদনার কাজ করেন। আর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত Ulysses করে তোলে তাঁকে সবার কাছে পরিচিত। হয়ে উঠেন বিশ্বখ্যাত।

A Portrait of the Artist

জেমস জয়েসের এই উপন্যাস আত্মজীবনীমূলক। এটি পূর্বে লিখিত “হিরো স্টিভ” থেকে পুনর্বিন্যাস করা হয়।

প্রথমবারের জন্য বইটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, জোসে হ্যারিয়েট উইভারের একজন বন্ধু, জার্নাল ইগোস্টের প্রাক্তন সম্পাদক, এর প্রচেষ্টাকে ধন্যবাদ। তারপর এটি অস্ট্রিয়া এবং অন্যান্য দেশে প্রকাশিত হয়েছিল।

লেখক স্টিভেন Dedalus নামে একটি নায়ক গঠন, ভবিষ্যতে উপন্যাস “Ulysses” প্রদর্শিত হবে বর্ণনা করে। জেমস জয়েস চরিত্রটি তার পরিবর্তে অহংকারের কথা বলেছেন। ড্যাডেলাস একই ভাবে ক্যাথলিকবাদের আর্গুমেন্ট এবং আয়ারল্যান্ডের আধুনিক সমাজের কাঠামোর নির্ভুলতা নিয়ে সন্দেহ করেন।

আরো পড়ুন:  ম্যারি অ্যান বিভান: সবচেয়ে কুদর্শন নারী নাকি সবচেয়ে অসাধারণ মা?
Credit: Amazon

ইউলিসিস

ইউলিসিসে মোট আঠারটা এপিসোড। হোমারের ‘ওডেসি’-তে ছিল চব্বিশটা। সকাল আটটায় কাহিনী শুরু, শেষ হচ্ছে রাত দুটোয় আত্মকথনে মগ্ন মলি বুমের শয্যাকক্ষে। এতে আধুনিক কালের একটা উপন্যাস প্রাচীন মহাকাব্য ‘ওডেসি’র সঙ্গে সমান্তরাল ধারার সৃষ্টি করছে, ডাবলিনের একটা দিন ‘ওডেসি’র দশ বছরের কাহিনীর সমতুল্যতা বা correspondence অর্জন করছে, আধুনিককালের এক নায়ক (বা বিপ্রতীপ নায়ক) গ্রিক মহাকাব্যের নায়কের সমতুল্য হচ্ছে। তবে এই সমতুল্যতার মধ্যে কিছু ফাঁক আছে, কিছু প্যারোডি ও ব্যঙ্গ আছে। ইউলিসিস তথা অডিসিউস একটার পর একটা সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে; লিওপোল্ড বুম ও স্টিফেন ডিডেলাস সারাদিন ডাবলিনের পথে পথে হেঁটেছে। একদিনে তারা ৪০ মাইল পথ পরিক্রম করেছে। আর নায়িকা মলি বুম তো পেনিলোপির ব্যঙ্গচিত্র হিসেবেও দাঁড়ায় না। পেনিলোপি হলেন দাম্পত্য বিশ্বস্ততার প্রতীক, এক যুগ ধরে স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষা করছেন; মলি বুম বহুচারিণী যিনি এই দিনও, ১৬ জুন, বিবাহেতর মিলনে রত হয়েছেন।

আর ডিডেলাস ও বুম যেহেতু আধুনিক নায়ক, তাদের সংকট অন্য ধরনের। পিতা ও পুত্রের পুনর্মিলনের মধ্যে এই সংকট শেষ হবার নয়। স্টিফেন ডিডেলাস ও তার পিতৃপ্রতিম লিওপোল্ড বুম দুজনই দো-মনা, বিচ্ছিন্ন, নাগরিকতাক্লিষ্ট। সংকট তাদের অন্য ধরনের। দুজনই একটা জায়গায় এসে হারিয়ে যাচ্ছে। বুম অর্ধেক-ইহুদি তাই আইরিশ ক্যাথলিক সমাজের একজন সে নয়। ডিডেলাস কবি হতে চায়। সে ঘর-ছাড়া, ইশকুলে চাকরি নিয়ে সেটাও ছেড়ে দিয়েছে, এক অনির্দেশ্য ন যাযৌ ন তস্থৌ অবস্থায় রয়েছে।

চেতনাপ্রবাহ শৈলী এই উপন্যাসের সবচেয়ে মৌলিক দিক। পরবর্তীকালের পোস্টমডার্ন উপন্যাসের ওপর ‘ইউলিসিসে’র প্রভাব সর্বব্যাপী। পরের যুগের পোস্টমডার্নরা এই শৈলীকে আরো জটিল করেছে। উপন্যাসে ভয়েস বদলে যাচ্ছে, উত্তম পুরুষে লিখিত উপন্যাস হঠাৎ তৃতীয় পুরুষে বর্ণিত হচ্ছে; ঔপন্যাসিক কখনো উপন্যাসের ভিতরের চরিত্র, কখনো উপন্যাসের বাইরের ন্যারেটর বা কথক। চরিত্রগুলো একে অন্যের মধ্যে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। চরিত্রগুলো অস্থিতিশীল। ইতালো কালভিনোর উপন্যাসের কাহিনীও অস্থিতিশীল। ‘যদি শীতের রাতে এক পথিক’ উপন্যাসে নায়ক একটা রেল ইস্টিশনে একটা উপন্যাস পড়ছে। স্টেশনের ঘটনা, অর্থাৎ উপন্যাসের কাহিনীর বাইরের প্রতিবেশে যা-কিছু ঘটছে এবং উপন্যাসের ভিতরকার কাহিনী এক হয়ে যাচ্ছে। পরে দেখা গেল নায়ক যে-উপন্যাস পড়ছে, বই বাঁধাইকারীর ভুলের জন্যে অন্য একটা উপন্যাসের ফর্মা এই বইয়ে বাঁধাই হয়ে গেছে যার ফলে একটা উপন্যাসের সঙ্গে আরেকটা উপন্যাস জড়িয়ে পড়েছে।

পোস্টমডার্নরা বলে সত্য অস্থিতিশীল। আর জন ফাউলস্ যিনি কয়েক বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং সমকালের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ইংরেজি ঔপন্যাসিকদের অন্যতম, তিনি তো তাঁর চরিত্রগুলোকে শাসনও করতে পারেন না; তাঁর চরিত্রগুলো স্ব-শাসিত, নিজের ইচ্ছায় চলে; স্রষ্টা ফাউল্সের কথা তারা শোনে না। পোস্টমডার্নদের উপাস্য দেবতা প্রটিউস, যার সবসময় চেহারা বদলাচ্ছে।

জয়েসের ‘ইউলিসিসে’র একটা এপিসোডের শিরোনাম প্রটিউস। জয়েসের অনুসারী উইলিয়াম ফকনরের উপন্যাসে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এই তিন কালপর্ব একে আপরের মধ্যে লীন হচ্ছে। ফকনরের বাক্যের গঠনেও tense বা ক্রিয়াকাল বিপর্যস্ত। আর হোর্হে লুইস বোর্হেস- তিনি কোনো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখেননি- রচনাগুলো fragmentary বা খণ্ডিত। সেখানে তো দেখা যায় ঔপন্যাসিক তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সঙ্গে এক ধরনের আদান-প্রদানে জড়িত। ‘ইউলিসিসে’র চেতনাশৈলী সবচেয়ে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে শেষের এপিসোডে যার শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘পেনিলোপি’, যার সমতুল্য মলি বুম। মলির চিন্তাগুলো একে অন্যের ওপর অপ্রতিহত গতিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, কোনো যতিচিহ্ন নেই বাক্য গঠনে, চিন্তাসূত্রে নেই কোনো বিন্যাস ।

আরো পড়ুন:  মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমির কবিতা: রুমির ১৫ টি বিখ্যাত কবিতা
Credit: Amazon

মৃত্যু

১৯৪১ সালে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন জেমস জয়েস। আর ঐ বছরেই তিনি জুরিখে মৃত্যুবরণ করেন ।

Featured Image Credit: TFT

Reference: Wikipedia, Britanica & History. Com

Leave a Reply