পৃথিবীতে স্বীকৃত মহাকাব্যের সংখ্যা চারটি।তার মধ্যে গ্রিক মহাকবি হোমার নিজেই লিখেছেন দুটো; একটি ইলিয়াড ও অপরটি ওডিসি। ইলিয়াড হোমারের রচিত প্রথম মহাকাব্য। হোমার তার দুটো মহাকাব্যই রচনা করেছিলেন খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে ১৩০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে যা প্রায় ৩২০০ থেকে ৩৩০০ বছর পূর্বে। হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যটির মূল বিষয়বস্তু ট্রয়যুদ্ধ। আরো নির্দিষ্ট করে যদি বলি তা হচ্ছে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলা ট্রয় যুদ্ধের শেষের দিকের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে ইলিয়াড মহাকাব্যে।
ইলিয়াড শব্দটি এসেছে ইলিয়াম শব্দ থেকে। পূর্বে ট্রয় নগরীকে ইলিয়াম নামেই ডাকা হতো। ট্রয় যুদ্ধের কথা শুনলে আমাদের প্রথমে যে প্রশ্নটা মাথায় আসে তা হলো ট্রয় নগরী বা ট্রয় যুদ্ধ বলে আসলে আদৌও কি কিছু ছিলো? নাকি পুরোটাই মানব মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনা? ট্রয় নগরী বলে যে কিছু ছিলো তার কিছু প্রত্মতাত্মিক নিদর্শনও পাওয়া গেছে। হেমারের মহাকাব্যের ট্রয় নগরীর অবস্থান বর্তমান তুরস্কের চানাক্কাল প্রদেশের ডারডেনলস প্রনালীর পাশে। ১৮৭০ সালের দিকে জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক হাইনরিশ শ্লিমান খনন কাজ চালিয়ে ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন। সেই ট্রয় নগরী ও ট্রয় যুদ্ধ গ্রীক হেলেনীয় সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে মানুষ ও দেবতার মিশেল তা রূপ নিয়েছে অসাধারন এক মহাকাব্যে।

হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্য শুরু হয়েছে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের দশম বছর থেকে। পার্টার রাজা ম্যানেলাসের স্ত্রী হেলেনকে অপহরণ করে নিয়ে আসে ট্রয় রাজপুত্র প্যারিস। গ্রিক বাহিনী হাজার জাহাজ নিয়ে ট্রয় নগরীর বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কারণ হেলেন তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম নারী। বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার ক্রিস্টো তার বিখ্যাত নাটক ডক্টর ফস্টাসে একটি চমৎকার মন্তব্য করেছিলেন হেলেনের অপূর্ব সৌন্দর্য নিয়ে।
Was this the face that launche’d a thousands ships,
And burnt the topless towers of illium?
দীর্ঘ নয় বছরের পরিশ্রমের পরেও গ্রীক বাহিনী ট্রয় নগরীর দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভাঙতে সক্ষম হয়নি। গ্রিক সৈন্য ও তাদের বাহিনীর প্রধান অ্যাগামেমনন ও কিছুটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অ্যাগামেমনন আর্গসের রাজা, সেই সাথে তিনি হেলেনের স্বামী ম্যানেলাউসের বড় ভাই।
অ্যাগামেমননের দুশ্চিন্তার অন্যতম বড় কারণ ছিল সম্প্রতি গ্রীক সেনা শিবিরে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। ফলাফলস্বরূপ বহু গ্রিক সেনা মারা গেছে। এই প্লেগ আক্রমণের পেছনের অন্যতম কারণ ছিল গ্রিক বাহিনী ট্রয় নগরের পাশের নগরগুলোতে হামলা করে তাদের সকল সম্পত্তি লুট করে এবং নারীদের নিজেদের লালসার বস্তুতে পরিণত করেছিল। সেই হামলায় তারা অন্যতম দুই সুন্দরী নারী সাইস্রিস ও ব্রিসিসকে উপঢৌকন হিসেবে অ্যাগামেমনন ও অ্যাকিলিসকে দেওয়া হয়৷ সাইস্রিসকে অ্যাগামেমনন নিজের সেবাদাসী হিসবে গ্রহণ করে, আর অন্যদিকে অ্যাকিলিস গ্রহণ করে ব্রিসিসকে।
সাইস্রিস ছিল গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরের পুরোহিত সাইস্রেসের মেয়ে। সাইস্রিসকে ছাড়াতে ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম অনেক উপঢৌকন পাঠালেও অ্যাগামেমনন সাইস্রিসকে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলাফলস্বরূপ বাধ্য হয়ে সাইস্রেস দেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরে নিজের মেয়েকে যে প্রার্থনা করেন। দেবতা অ্যাপোলো নিজের একনিষ্ঠ ভক্তের কথা শুনেন এবং শাস্তিস্বরূপ গ্রীক সেনা শিবিরে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে দেন। ফলে বহু গ্রিক সৈনিক মারা যেতে থাকে। অ্যাগামেমননের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। তখন অ্যাগামেমননের উপদেষ্টা কলকাস অ্যাগামেমননকে জানান দেবতা অ্যাপোলো তাদের ওপর ভয়ংকর রুষ্ট হয়ে প্লেগ রোগ দিয়েছেন। সেই সাথে তিনি অ্যাগামেমননকে পরামর্শ দেন এখনই পুরেহিত কণ্যা সাইস্রিসকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে।

অ্যাগামেমনন সাইস্রিসকে মুক্ত করে দেন কিন্তু এর পরিবর্তে তিনি অ্যাকিলিসের উপপত্নী বা প্রেমিকা ব্রিসিস কে গ্রহণ করেন। এহেন ঘটনার পর অ্যাকিলিস অ্যাগামেমননের উপর ক্রোধান্বিত হয়ে যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করেন। অ্যাকিলিস ছিলেন গ্রীকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। সে ছিল অপ্রতিরোধ্য এবং সে ছিলে সমুদ্র দেবী থেটিস ও রাজা পেলিয়াসের সন্তান। এর ফলে সেই হয়েছে অর্ধেক দেবতা ও অর্ধেক মানব গুণসম্পন্ন একজন ব্যক্তি।
অ্যাকিলিস যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করার গ্রিকরা যুদ্ধে পিছিয়ে যায় এবং ট্রোজনরা/ট্রয়রা যুদ্ধে সুবিধা জনক অবস্থান নিয়ে নেয়। এর মূল কারণ গ্রিকদের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ছিল অ্যাকিকিস। অ্যাকিলিস যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করায় গ্রিকরা অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে। অ্যাকিলিস যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় অ্যাকিলিসের প্রিয় বন্ধু পেট্রোক্লাস অ্যাকিলিসের বর্ম পরিধান করে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়ে। পেট্রোক্লাস যুদ্ধের ময়দানে বীরপুরুষের মতো লড়াই করতে থাকে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে পেট্রোক্লাস মুখোমুখি হয় ট্রয় রাজপুত্র ও শ্রেষ্ঠ ট্রয় যোদ্ধা হেক্টরের। দুজনের মধ্যে তুমুল লড়াইয়ে হেক্টরের হাতে প্রাণ হারায় পেট্রোক্লাস। অ্যাকিলিসের বর্ম পড়ে থাকার কারণে হেক্টর ভেবেছিল সে অ্যাকিলিসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। পেট্রোক্লাস লড়াইয়ে পরাজিত হবার পর হেক্টর বুঝতে পারে সে অ্যাকিলিস নয় অ্যাকিলিসের বর্ম পরিহিত অ্যাকিলিসের প্রিয় বন্ধু পেট্রোক্লাসকে হত্যা করেছে।
অ্যাকিলিস প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তার মা, থেটিস, তার কান্না শুনে সান্ত্বনা দিতে ছুটে আসেন। অ্যাকিলিস অভিযোগ করেন যে হেক্টর প্যাট্রোক্লাসকে ভুলে ধরে নিয়েছিল যে তিনি নিজে অ্যাকিলিস। হেক্টর কেবল তার প্রিয় বন্ধুকেই হত্যা করেননি, বরং হেক্টর অ্যাকিলিসের সুন্দর বর্মটিও ছিনিয়ে নিয়েছে। সমুদ্র দেবী থেটিস তখন নিজের সন্তান অ্যাকিলিসের ভবিষ্যাণী করে বলেন যে, “হেক্টরের পরেই তার অ্যাকিলিসের মৃত্যু ঘটবে।”
সেসময় দেবতা ইরিস একটি বার্তা নিয়ে অ্যাকিলিসের কাছে আসেন, যা হেরা থেকে পাঠানো হয়েছিল, নতুন বর্ম সংক্রান্ত। থেটিস দেবতা হেফাইস্টাসের কাছে যান, যিনি দেবতাদের সমরাস্ত্রের কারিগর, এবং তাকে অনুরোধ করেন তার ছেলের জন্য নতুন বর্ম তৈরি করতে। দেবতা হেফাইস্টাস সোনা, রূপা ও লোহার মিশেলে এক অসাধারণ কারুকার্যখচিত একটি বর্ম তৈরি করেন। হোমারের ইলিয়ড মহাকাব্যের ১৮ নম্বর অধ্যায়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই বর্ণনা করা হয়েছে সেই বর্মের সৌন্দর্য।
অ্যাকিলিসের সেই বর্মে প্রদর্শিত ছিল পৃথিবী ও আকাশ, সাগর, সূর্য, পূর্ণচন্দ্র, নক্ষত্র ও হান্টার ও বাঘ; এগুলো সব ঘূর্ণায়মানভাবে দেখানো হয়েছে। এছাড়াও, সেখানে ছিল দুই শহরের দৃশ্য, একটি শহরে দেখাচ্ছে লোকেরা উৎসব করছে, বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। শিশুরা আনন্দে নৃত্য করছে। কৃষকরা ফসল ফলিয়ে আনন্দের হাসি হাসছে। অপরদিকের অন্য শহরে দেখাচ্ছে সৈন্যরা লড়াই করছে, আশেপাশে পড়ে আছে বহু নিথর লাশ। আর চারাপশে সব ধ্বংসের চিহ্ন। হোমার এই বর্মের মাধ্যমে শুধু যুদ্ধের সরঞ্জাম নয়, বরং মানুষের জীবন, সমাজ, যুদ্ধ, শান্তি, আনন্দ, দুঃখ সবকিছুরই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে অ্যাকিলিস আবারও গ্রীক যুদ্ধ শিবিরে ফিরে আসেন। বন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে অ্যাকিলিস হেক্টরকে দ্বৈত যুদ্ধ লড়বার আহ্বান জানায়। ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম চাচ্ছিলেন না তার নিজের সন্তানকে অ্যাকিলিসের মুখোমুখি দাঁড় করাতে। তিনি জানেন অ্যাকিলিসের মুখোমুখি দাঁড়ানো মানেই তার প্রিয় সন্তান হেক্টরের মৃত্যু সুনিশ্চিত। হোমার এই অংশটায় এসে হেক্টর তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে অসাধারণ এক আবেগময় দৃশ্যের সৃষ্টি করেছেন।
স্ত্রী,সন্তান, পিতা-মাতা ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল হেক্টর অ্যাকিলিসের বিরুদ্ধে দ্বৈতযুদ্ধে অংশ নেন। দুজনের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। হেক্টর তার অসাধারণ সাহস ও নৈপুণ্য দেখান। কিন্তু অ্যাকিলিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পেড়ে ওঠা যে অসম্ভব। একেতো অ্যাকিলিস অর্ধেক দেবতা ও অর্ধেক মানুষ; সেই সাথে সে দেবতাদের বিশেষ আশীর্বাদ পুষ্ট। লড়াইয়ে হেক্টর হেরে যায়। মৃত্যুর আগে হেক্টর অ্যাকিলিসকে অনুরোধ করেছিল, তাকে হত্যার পর তার দেহ যেন তার নগরবাসীর হাতে হস্তান্তর করে। যেন তারা হেক্টরের শেষকৃত্য করতে পারে।
অ্যাকিলিস হেক্টরের কথা শুনেনি। কারণ তার মন তখন প্রতিশোধ নেবার স্পৃহায় ভয়াবহ নিষ্ঠুর রূপ ধারণ করেছে। হেক্টর কে হত্যার পর অ্যাকিলিস হেক্টরের মৃতদেহ ঘোরার পেছনে বেঁধে গ্রিক শিবিরের চারদিকে ঘোরায়। হেক্টরের মৃতদেহের উপর চালানো অমানবিক কর্মকান্ডকে হোমার দেখিয়েছিলেন যুদ্ধের অমানবিক ও নিষ্ঠুর বর্বরতাকে।
অ্যাকিলিস হেক্টরের মৃতদেহকে তিন দিন এভাবেই ফেলে রেখেছিলেন। তিনদিন পর মধ্যরাতে ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম লুকিয়ে অ্যাকিলিসের শিবিরে প্রবেশ করেন। তিনি অ্যাকিলিসকে বিনীত অনুরোধ করেন, যেন সে তার সন্তান হেক্টরের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়। অ্যাকিলিস মানবিক দিক বিবেচনা করে বৃদ্ধ রাজাকে তার মৃত সন্তানের দেহ হস্তান্তর করেন। ট্রয় নগরবাসী ও রাজা প্রিয়াম হেক্টরের জন্য এক রাজকীয় শেষকৃত্যের আয়োজন করেন। হেক্টরের শেষকৃত্য ও ট্রয় নগরীর শোকাহত দৃশ্যের মাধ্যমেই হেমারের ইলিয়াড মহাকাব্যের সমাপ্তি ঘটেছে।