You are currently viewing অ্যাডোনিস: গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ

অ্যাডোনিস: গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ

অ্যাডোনিস গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ, যার সৌন্দর্যে মজেছিলেন স্বয়ং গ্রীক দেবী আফ্রোদিতি। তবে অ্যাডোনিস ও দেবী আফ্রোদিতির প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, বন্য জন্তুর আক্রমনে প্রেমিক অ্যাডোনিস কে হারিয়ে এক দীর্ঘকালীন বিষাদে ডুবে গিয়েছিলেন দেবী আফ্রোদিতি।

অ্যাডোনিস এর জন্ম ও মৃত্যু এতোটাই বিস্ময়কর যে তা আমাদেরকে গ্রীক উপকথার এক আশ্চর্য জগতে টেনে নিয়ে যায়। যে জগতে রয়েছে অজাচার, প্রার্থনা, ক্ষমা, অলৌকিক ঘটনা, প্রাণের রক্ষা, বিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতা; বিচার, প্রেম ও করুন মৃত্যুর এক আশ্চর্য সমাহার।

যেহেতু অ্যাডোনিস ছিলেন খুবই সুদর্শন এক তরুণ তাই মেয়েরা ছিলো তার একান্ত ভক্ত। আর সেজন্যই ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের তরুণীদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল ‘দি কাল্ট অভ ডায়িং অ্যাডোনিস’ । এমনকি প্রাচীন গ্রীক নারী কবি সাপ্পোও এই সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।

অ্যাডোনিসের জন্ম হয়েছিলে অজাচারের মাধ্যমে

গ্রীক মিথলজিতে অজাচার খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তেমনই স্মার্না নামে একটি তরুণী বাবার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। বাবার নাম সিনাইরাস, কারও কারও মতে থিয়াস। গ্রিক উপকথায় আমরা কখনও কখনও মনোবিজ্ঞানের ছায়াপাত দেখি। যে কারণে বাবার প্রতি নিষিদ্ধ প্রেমের কারণে অপরাধবোধে জর্জরিত হতে দেখি স্মার্না কে।

স্মার্না কিন্তু এক অদ্ভুত কথা বলেছিল; যা আমরা রোমান লেখক ওভিদ এর একটি লেখায় (মেটামোরফসিস) পাই।

Human civilization has made spiteful laws, and what nature allows, the jealous laws forbid.এর মানে: মানবসভ্যতা বিদ্বেষপূর্ন বিধান রচনা করেছে। প্রকৃতি যা অনুমোদন করে ঈর্ষান্বিত বিধান তাই নিষিদ্ধ করে!

আচার্যরা ছিঃ ছিঃ করলেও স্মার্নার কথাটা ভাবার মতোই বটে।

সে কালের পুরুষেরা ছিল বহু নারীর দ্বারা তুষ্ট। থিয়াসের এক ঘনিষ্ট সেবিকা ছিল। সেই সেবিকার নাম হিপ্পোলিটা। হিপ্পোলিটার মনে বিপর্যস্ত স্মার্নাকে দেখে দয়ার উদ্রেক হয়। হিপ্পোলিটা বুদ্ধি খাটিয়ে স্মার্নার সুপ্ত বাসনা পূর্ণ করবার একটা উপায় বার করে।

অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রিবেলায় স্মার্না কে থিয়াস এর ঘরে নিয়ে যায় হিপ্পোলিটা… এবং ছল করে কন্যাকে বাবার শয্যায় উঠিয়ে দেয়। অন্ধকার ঘরে মদ পান করছিল থিয়াস। হিপ্পোলিটা থিয়াস-এর কাছে যায় এবং ফিসফিসে আদুরে কন্ঠে বলে: প্রভু।

বল।

আপনার শয্যায় একজন অপেক্ষা করছে।

কে? থিয়াস কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

যে আপনাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে। অন্ধকারে হিপ্পোলিটা মৃদু হেসে বলে।

নতুন নারীদেহের লোভে থিয়াস পানপাত্র রেখে শয্যার দিকে যেতে থাকে। আপন কন্যার সঙ্গে মিলিত হয়।

পরপর কয়েক রাত এমন নিষিদ্ধ প্রেম সংঘটিত হয়।

এসব ঘটনা চাপা থাকে কি?

যখন থিয়াস জানতে পারে সে তার কন্যার সুপ্ত মনোবাসনার শিকার … তখন সে ক্রোধে উন্মক্ত হয়ে ওঠে এবং দ্রুত তরবারী টেনে নেয়। তারপর মেয়েকে ধাওয়া করে। (আর সেই দৃশ্য দেখে মৃদুহাসি হপসেছিল হিপ্পোলিটা)

স্মার্না প্রাণ ভয়ে ছুটছে। ছুটন্ত স্মার্না প্রার্থনায় রত হয়। যেন সে হতে পারে অদৃশ্য, যেন বাবা তাকে না দেখতে পারে। হয়ত স্বর্গের দেবদেবীগন মেয়েটিকে ভালোবাস। দেবগন দয়ার বশবর্তী হয়ে ছুটন্ত মেয়েটিকে একটি স্মার্না বৃক্ষে রূপান্তরিত করে দেন।

ঘটনাটি কোথায় ঘটল?

পরবর্তী কাহিনী অনুসারে মনে হয় বর্তমানকালের সিরিয়া-লেবাননের কোথাও ঘটেছিল ওই অলীক ঘটনা। যা হোক। সুগন্ধী স্মার্না বৃক্ষ থেকে উৎপন্ন হয় গন্ধরস। এ গাছের গুঁড়ো থেকেই নাকি উৎপন্ন হয় হয় ধূপ । যা হোক। দশ মাস পর বৃক্ষটি বিস্ফোরিত হয় ও একটি সুন্দর শিশুপুত্র বেরিয়ে আসে। এই হল অ্যাডোনিস-এর জন্মকথা।

অ্যাডোনিস এর জন্ম হয়েছিলো যে বৃক্ষ হতে তার পাশেই সদ্য জন্মানো শিশু অ্যাডোনিস কে ঘিরে গ্রীক দেবতারা Image Credit: Wikipedia
মানচিত্রে লেবানন। এখানেই ছিল প্রাচীন ফিনিসিয় সভ্যতা। বিবলস নগর। অ্যাডোনিস নামে একটি নদী, যে নদীর উৎপত্তি স্থলে এককালে সুগন্ধী স্মার্না বৃক্ষ বিস্ফোরিত হয়ে অ্যাডোনিস এর জন্ম হয়েছিল।

এই ঘটনার পর গ্রীক দেবতাদের মধ্যে হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
একটি সুগন্ধী স্মার্না বৃক্ষের কাছে সদ্য প্রসূত একটি শিশুকে কে দেখতে পান দেবী। থমকে যান দেবী। শিশুটি দেখতে অসম্ভব ফুটফুটে ছিল। দেবীর বুক কাঁপে। একে যেন দেবতারা কোনওমতেই দেখতে না পায়। এই ভেবে আফ্রোদিতি শিশুটিকে একটি আলমারীর ভিতরে লুকিয়ে রাখে। তবে অ্যাডোনিস নামটি দেবী আফ্রোদিতি রাখে কি না বলতে পারি না।

এরকম চাঞ্চল্যকর তথ্য চেপে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল দেবীর। কথাটা শেষমেশ দেবী ফাঁস করে দেয় পাতালের রানী পার্সিফোনে-র কাছে। পার্সিফোনে যখন অ্যাডোনিস কে দেখল তখন কেড়ে নিল! আর ফেরৎ দিল না।
বিচারের আশায় বিবাদমান দু’পক্ষ জিউসএর দরবারে গেল।

বিজ্ঞ জিউস বৎসরকে ভাগ করলেন তিন ভাগে। এক ভাগ অ্যাডোনিস-এর নিজের। অপর ভাগে

দেবী আফ্রোদিতি আর অ্যাডোনিস একত্রে থাকবে ; এবং শেষ ভাগে পাতালের রানী পার্সিফোনে আর অ্যাডোনিস একত্রে থাকবে।

জিউস আসলে বিচারের ভার দিয়েছিলেন মিউজ ক্যাললিওপিকে। ক্যাললিওপির সন্তান অর্ফিউস। ক্যাললিওপির অন্যায্য বিচারের ফলে অর্ফিউস এর মৃত্যু ঘটেছিল। কী ভাবে বলি। মিউজ ক্যাললিওপি এই রায় দিয়েছিল যে পার্সিফোনে ও আফ্রোদিতি বছরের অর্ধেক সময় করে অ্যাডোনিস এর সঙ্গে থাকবে। এই রায়ের ফলে আফ্রোদিতি ক্রোধে উন্মক্ত হয়ে যায়। অর্ফিউস সে সময় ছিল থ্রাসে । থ্রাসের নারীদের ওপর আফ্রোদিতির ছিল দারুণ প্রভাব। অর্ফিউস এর বিরুদ্ধে থ্রাসের নারীদের লেলিয়ে দেয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। (এই হল গ্রিক মিথের ভয়ঙ্কর রূপ!)

গ্রিক মিথের আরেক বৈশিষ্ট হল কাহিনীর দ্রুত পরিবর্তন। আমরা থিয়াস ও স্মার্নার অজাচারের প্রসঙ্গে ছিলেন। এখন দেখলাম থ্রাসের নারীদের খুনি চেহারা। একটু পরই দেখব। বনভূমির গভীরে অ্যাডোনিস ও দেবী আফ্রোদিতির প্রনয় …প্রখ্যাত ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট বলেছিলেন: ‘উইদ হোমার আওয়ার ট্র্যাডিশন স্টারটেড।’ এর অর্থ (মহা কাব্যের কবি) হোমার থেকেই আমাদের ঐতিহ্যের সূচনা।

মনে থাকার কথা দেবতা জিউস বৎসরকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন।
এক ভাগ অ্যাডোনিস-এর নিজের। নিজের ভাগটি অবশ্য অ্যাডোনিস ভালোবেসে দিল দেবী আফ্রোদিতি কে। এই কারণেই অ্যাডোনিস কে দেবলোকের একজন মনে করা হয় । (আর মনে রাখতে হবে অ্যাডোনিস ততদিন আর শিশুটি নেই হয়ে উঠেছে সুন্দর তরুণ।)
প্রেমিক প্রেমিকার মতোই অ্যাডোনিস ও আফ্রোদিতি বহুবছর একত্রে কাটিয়েছিল। বনপাহাড়ে শিকার করে করে আর একে অন্যকে নানারকম গল্প বলে বলে।

অ্যাডোনিস ও দেবী আফ্রোদিতি Image Credit: Wikipedia

এর পরের ঘটনা ভীষণ রকম বাঁক নিল। মনে রাখতে হবে মিউজ ক্যাললিওপির সেই রায়ের ফলে আফ্রোদিতি ক্রোধে উন্মক্ত হয়ে যায়। অর্ফিউস সে সময় ছিল থ্রাসে । থ্রাসের নারীদের ওপর আফ্রোদিতির ছিল দারুণ প্রভাব। অর্ফিউস এর বিরুদ্ধে থ্রাসের নারীদের লেলিয়ে দেয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। …গ্রিক উপকথায় দেখতে পাই একের পর এক প্রতিশোধের পালা।

এবার আফ্রোদিতির দুঃখ পাবার সময় হল!

কী কারণে আফ্রোদিতি হিংস্র বন্য জন্তু শিকার করতে নিষেধ করেছিল অ্যাডোনিস কে । কেবল নিরাপদ জন্তু শিকার করতে বলেছিল। যেমন, খরগোশ, হরিণ ইত্যাদি। হায়। বনাঞ্চলে একদিন একটি বন্য শূকর দেখামাত্র অ্যাডোনিস প্রলুব্দ হয়। অ্যাডোনিস ধারালো বর্শা ফলক ছুড়ে শূকরটিকে আহত করে। শূকরটিও বিদ্যুৎ গতিতে প্রতিআক্রমন করে। ফলে অ্যাডোনিস ক্ষতবিক্ষত হয়। সে আর্ত চিৎকার করে। তার গোঙ্গানি শুনে ছুটে আসে আফ্রোদিতি । রক্তাক্ত প্রেমিককে দেখে বিলাপ করল।

অ্যাডোনিসের মৃত্যু Image Credit: New orleas meuseam of art

আফ্রোদিতির বাহুতে মাথা রেখে মৃত্যুবরণ করে অ্যাডোনিস ।
মৃত্যুর পর অ্যাডোনিস-এর রক্ত নির্যাস ও অ্যানিমোন ফুলের সঙ্গে মিশিয়ে ছিটিয়ে দেয় শোর্কাত দেবী…

আফ্রোদিতি ও অ্যাডোনিস এর মিলনে এক কন্যার জন্ম হয়েছিল। সে কন্যার নাম বিরৌ।লেবাননের বৈরুত নগরের নাম সেই কন্যার নামেই নাকি রাখা হয়েছিল। এবং দেবতা ডায়ানিসাস ও পোসাইদোন সে মেয়ের প্রেমে পড়েছিল।ফিনিসিয় নগর বিবলসের নিকট অ্যাডোনিস নামে একটি নদী আছে।

Image credit: Flickr

প্রতি বসন্তে সে নদীর জল লাল হয়ে ওঠে। ওই অঞ্চলের লোকের বিশ্বাস অ্যাডোনিস নদীর উৎপত্তি স্থলেই নাকি এককালে সুগন্ধী স্মার্না বৃক্ষ বিস্ফোরিত হয়ে অ্যাডোনিস এর জন্ম হয়েছিল।

Leave a Reply

This Post Has 2 Comments

  1. Partha Das

    Great things to know, It a pleasure to know about
    The ancient mythological stories.

    1. মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ব্লগে কমেন্ট খুব একটা পাই না। তবে পেলে ভালো লাগে নতুন প্রেরণা পাই।