অ্যাডোনিস গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ, তিনি এতোটাই সুন্দর ছিলেন যে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতিও সেই সৌন্দর্যে ডুবে ছিলেন। তবে তাদের এই প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বন্য জন্তুর আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন অ্যাডোনিস। অ্যাডোনিসের এমন আকষ্মিক মৃত্যুতে দীর্ঘদিন বিষাদে ডুবে ছিলেন স্বয়ং প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি।
অ্যাডোনিসের জন্ম ও মৃত্যু খুবই আশ্চর্যজনক ও বিষ্ময়কর। এজন্য আমাদের যেতে হবে গ্রীক উপকথায়। যে উপকথার জগতে রয়েছে অজাচার,অলৌকিকতা, প্রেম, কিংবা করুন মৃত্যুর এক আশ্চর্য সমাহার।
অ্যাডোনিসের জন্ম হয়েছিলে অজাচারের মাধ্যমে
গ্রীক মিথলজিতে অজাচার খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তেমনই স্মার্না নামে একটি তরুণী বাবার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। স্মার্নার বাবার নাম সিনাইরাস, কারও কারও মতে তার নাম থিয়াস।
সে কালের পুরুষেরা ছিল বহু নারীর দ্বারা তুষ্ট। বোধহয় এই আধুনিক যুগেও পুরুষরা তার ব্যাতিক্রম মানুষিকতা খুবই কম পোষণ করেন। যাই হোক থিয়াসের এক ঘনিষ্ট সেবিকা ছিল। সেই সেবিকার নাম ছিল হিপ্পোলিটা। হিপ্পোলিটার মনে বিপর্যস্ত স্মার্নাকে দেখে দয়ার উদ্রেক হয়। হিপ্পোলিটা বুদ্ধি খাটিয়ে স্মার্নার সুপ্ত বাসনা পূর্ণ করবার একটা উপায় বের করেন।
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রিবেলায় স্মার্না কে থিয়াস এর ঘরে নিয়ে যায় হিপ্পোলিটা… এবং ছল করে কন্যাকে বাবার শয্যায় উঠিয়ে দেয়। অন্ধকার ঘরে মদ পান করছিল থিয়াস। হিপ্পোলিটা থিয়াস-এর কাছে যায় এবং ফিসফিসে আদুরে কন্ঠে বলে: প্রভু, আপনার শয্যায় একজন অপেক্ষা করছেন। থিয়াস কৌতুহলী হয়ে উঠে। হিপ্পোলিটা মৃদু হেসে বলে সে আপনাকে ভালোবাসে।
নতুন নারীদেহের লোভে থিয়াস পানপাত্র রেখে শয্যার দিকে যেতে থাকে। অতপর নিজ আপন কন্যার সঙ্গে মিলিত হয়। পরপর কয়েক রাত মদ্যপ বাবার সাথে মেয়ের নিষিদ্ধ যৌনসুখ চলতে থাকে।
এই ঘটনা চাপা থাকেনি। থিয়াস যখন জানতে পারে সে তার কন্যার সুপ্ত মনোবাসনার শিকার হয়েছে, তখন সে ক্রোধে উম্মাদ হয়ে ওঠে এবং দ্রুত তরবারী টেনে নেয়। তারপর মেয়েকে ধাওয়া করে। আর সেই দৃশ্য দেখে মৃদুহাসি হাসছিল হিপ্পোলিটা
স্মার্না প্রাণ ভয়ে ছুটছে। ছুটন্ত স্মার্না প্রার্থনায় রত হয়। যেন সে হতে পারে অদৃশ্য, যেন বাবা তাকে না দেখতে পারে। হয়ত স্বর্গের দেবদেবীগন মেয়েটিকে ভালোবাস। দেবতাগন দয়ার বশবর্তী হয়ে ছুটন্ত মেয়েটিকে একটি স্মার্না বৃক্ষে রূপান্তরিত করে দেন।
গ্পরীক উপকথার কাহিনী অনুসারে ধারণা করা হয় এই ঘটনাটি বর্তমানকালের সিরিয়া-লেবাননের কোথাও ঘটেছিল। যাই হোক দশ মাস পর বৃক্ষটি বিস্ফোরিত হয় ও একটি সুন্দর শিশুপুত্র বেরিয়ে আসে। আর এই হল অ্যাডোনিস-এর জন্মকথা।
এই ঘটনার পর গ্রীক দেবতাদের মধ্যে হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
একটি সুগন্ধী স্মার্না বৃক্ষের কাছে সদ্য প্রসূত একটি শিশুকে কে দেখতে পান দেবী। থমকে যান দেবী। শিশুটি দেখতে অসম্ভব ফুটফুটে ছিল। দেবীর বুক কাঁপে। একে যেন দেবতারা কোনওমতেই দেখতে না পায়। এই ভেবে আফ্রোদিতি শিশুটিকে একটি আলমারীর ভিতরে লুকিয়ে রাখে। তবে অ্যাডোনিস নামটি দেবী আফ্রোদিতি রেখেছেন কিনা সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না।
এরকম চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনা চেপে রাখতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল দেবীর। কথাটা শেষমেশ দেবী ফাঁস করে দেয় পাতালের রানী পার্সিফোনে-র কাছে। পার্সিফোনে যখন অ্যাডোনিস কে দেখল তখন আফ্রোদিতি থেকে অ্যাডোনিস থেকে কেড়ে নিল! আর ফেরৎ দিল না।
বিচারের আশায় বিবাদমান দু’পক্ষ জিউসএর দরবারে গেল।
বিজ্ঞ জিউস এই বিচারের ভার দেন আর্ফিউসের উপর। আর্ফিউস বৎসরকে ভাগ করলেন তিন ভাগে। এক ভাগ অ্যাডোনিস-এর নিজের। অপর ভাগে দেবী আফ্রোদিতি আর অ্যাডোনিস একত্রে থাকবে ; এবং শেষ ভাগে পাতালের রানী পার্সিফোনে আর অ্যাডোনিস একত্রে থাকবে।
এই রায়ের ফলে আফ্রোদিতি ক্রোধে উন্মক্ত হয়ে যায়। অর্ফিউস সে সময় ছিল থ্রাসে । থ্রাসের নারীদের ওপর আফ্রোদিতির ছিল দারুণ প্রভাব। অর্ফিউস এর বিরুদ্ধে থ্রাসের নারীদের লেলিয়ে দেয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।
যাই হোক বিচারে বৎসরে যে তিনটি ভাগ হয়েছিল। তারমধ্যে নিজের ভাগটি অবশ্য অ্যাডোনিস ভালোবেসে দিল দেবী আফ্রোদিতি কে। এই কারণেই অ্যাডোনিস কে দেবলোকের একজন মনে করা হয়। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন এই সময়টায় অ্যাডোনিস আর শিশুটি নেই, তিনি হয়ে উঠেছে সুন্দর তরুণ।
প্রেমিক প্রেমিকার মতোই অ্যাডোনিস ও আফ্রোদিতি বহুবছর একত্রে কাটিয়েছিল। বনপাহাড়ে শিকার করে করে আর একে অন্যকে নানারকম গল্প বলে বলে।
এর পরের ঘটনা ভীষণ রকম বাঁক নিল। মনে রাখতে হবে রায়ের ফলে আফ্রোদিতি ক্রোধে উন্মক্ত হয়ে যায়। অর্ফিউস সে সময় ছিল থ্রাসে । থ্রাসের নারীদের ওপর আফ্রোদিতির ছিল দারুণ প্রভাব। অর্ফিউস এর বিরুদ্ধে থ্রাসের নারীদের লেলিয়ে দেয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। …গ্রিক উপকথায় দেখতে পাই একের পর এক প্রতিশোধের পালা।
এবার আফ্রোদিতির দুঃখ পাবার সময় হল!
কী কারণে আফ্রোদিতি হিংস্র বন্য জন্তু শিকার করতে নিষেধ করেছিল অ্যাডোনিস কে। কেবল নিরাপদ জন্তু শিকার করতে বলেছিল। যেমন, খরগোশ, হরিণ ইত্যাদি। হায়। বনাঞ্চলে একদিন একটি বন্য শূকর দেখামাত্র অ্যাডোনিস প্রলুব্দ হয়। অ্যাডোনিস ধারালো বর্শা ফলক ছুড়ে শূকরটিকে আহত করে। শূকরটিও বিদ্যুৎ গতিতে প্রতিআক্রমন করে। ফলে অ্যাডোনিস ক্ষতবিক্ষত হয়। সে আর্ত চিৎকার করে। তার গোঙ্গানি শুনে ছুটে আসে আফ্রোদিতি । রক্তাক্ত প্রেমিককে দেখে বিলাপ করল।
আফ্রোদিতির বাহুতে মাথা রেখে মৃত্যুবরণ করে অ্যাডোনিস ।
মৃত্যুর পর অ্যাডোনিস-এর রক্ত নির্যাস ও অ্যানিমোন ফুলের সঙ্গে মিশিয়ে ছিটিয়ে দেয় শোর্কাত দেবী…
আফ্রোদিতি ও অ্যাডোনিস এর মিলনে এক কন্যার জন্ম হয়েছিল। সে কন্যার নাম বিরৌ।লেবাননের বৈরুত নগরের নাম সেই কন্যার নামেই নাকি রাখা হয়েছিল। এবং দেবতা ডায়ানিসাস ও পোসাইদোন সে মেয়ের প্রেমে পড়েছিল।ফিনিসিয় নগর বিবলসের নিকট অ্যাডোনিস নামে একটি নদী আছে।
প্রতি বসন্তে সে নদীর জল লাল হয়ে ওঠে। ওই অঞ্চলের লোকের বিশ্বাস অ্যাডোনিস নদীর উৎপত্তি স্থলেই নাকি এককালে সুগন্ধী স্মার্না বৃক্ষ বিস্ফোরিত হয়ে অ্যাডোনিস এর জন্ম হয়েছিল।