জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমা করতে পারেননি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। অথচ একসময় এই শরৎচন্দ্রকেই ঈশ্বরের মতো শ্রদ্ধা করতেন শিবরাম।(শিবরাম চক্রবর্তী)
নিজের একটি বইয়ের পান্ডুলিপিও নিয়ে গেছিলেন শরৎচন্দ্রের কাছে, ‘যদি দুটো লাইন লিখে দেন ভূমিকায় তাহলে একটা প্রকাশক জোটে’ এই আশায়।
লিখেও দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। সেই সম্পর্কই এক ঘটনায় চুরমার হয়ে গেল।
‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম। নাম হয়েছিল ‘ষোড়শী’। সকলেই জানে সে কথা। স্বয়ং লেখকও জানেন।
অথচ সেই নাটক যখন ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশ পেল সেখানে নাট্যকারের নাম বদলে শরৎচন্দ্রের নাম!
শিবরামের বদলে শরৎবাবুর নাম দিলে পত্রিকা বিক্রি হবে বেশি। সম্পাদকের যুক্তিতে চুপ থাকলেন শিবরাম। নাটক নিয়ে গেলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কাছে। নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত নাট্যাচার্য।
”অসাধারণ নাট্যরূপ দিয়েছেন! আমি করব।”
শুরু হল শো। প্রায় প্রতিদিনই হাউসফুল। এদিকে তখন দেনার দায় জর্জরিত খোদ নাট্যকার শিবরাম।
নাট্যাচার্যকে বললেন, ‘শিশিরবাবু, কিছু টাকা পেলে ভাল হয়। নাটকে আমার লভ্যাংশ থেকে যদি কিছু দিতেন।’
নাটকের বেনিফিট শোয়ের দিন শিবরামকে আসতে বললেন শিশির কুমার। গেলেন।
শো শেষে সাজঘরে গিয়ে হাত পাততেই শিশিরকুমার বললেন, ‘দেরি করে ফেললেন। আজ টিকিট বিক্রির সব টাকা একটি থলেতে ভরা ছিল, শো শেষ হতেই শরৎবাবু সাজঘরে এসে সব টাকা নিয়ে চলে গেলেন।’.
‘সে কী! আপনি বললেন না আমার কথা!’ হতবাক শিবরাম।
‘বলেছিলাম।’ শরৎ উত্তরে আমায় বললেন, ‘শিবরাম টাকা দিয়ে কী করবে? বিয়ে-থা করেনি, কিচ্ছু না। ছেলেপুলে নেই, ঘর-সংসার নেই, টাকার তার কীসের দরকার?’ আমি বললাম তবু কিছু দিন অনুগ্রহ করে…। খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে ও। আজ আসবে ও কিছু টাকার আশায়। শুনে বললেন, ‘না না। এই বেনিফিট নাইটের বখরা ওকে দিতে যাব কেন? এ রাত্তিরে টিকিট বিক্রি হয়েছে আমার নামে। এর মধ্যে শিবরাম আসছে কোথা থেকে!’ বলে টাকার থলে নিয়ে একটু বেশিই তাড়াতাড়ি চলে গেলেন শরৎ । হয়তো আপনার মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেই জন্যই।
শিশিরকুমারের কাছে এই কথা শুনে চুপ শিবরাম। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না!
মাথা নিচু করে ফিরে আসছেন, পিছন থেকে ডাক দিলেন শিশিরকুমার, ‘দাঁড়ান একটু।’ বলে একজনকে বললেন, ‘আমার চেকবইটা নিয়ে আয় তো।’
চেকবই এল।
‘আমার অ্যাকাউন্টে কত আছে জানিস?’
‘একশো কুড়ি টাকা।’
‘শিবরামবাবু, আপনার নামের বানান বলুন।’
‘আমার তো কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই।’
‘বেশ তাহলে এই একশো কুড়ি টাকারই একটা সেলফ চেক কেটে দিলাম। আমার আর কিছু নেই, বিশ্বাস করুন, থাকলে সেটুকুও দিতাম। কিছু মনে করবেন না।’
সেই চেক হাতে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত মনে ফিরে এসেছিলেন শিবরাম। কথাশিল্পীর প্রতি জমে ওঠা এত দিনের শ্রদ্ধা যেন চোখের সামনে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল।
যে শিবরাম কখনও কারও নিন্দা করেননি, সেই তিনিও ‘দরদি’ কথাশিল্পীর অমন আঘাত ভুলতে পারেননি শেষ দিন পর্যন্ত।
তথ্যসূত্র: আনন্দ বাজার পত্রিকার থেকে নেওয়া অংচবিশেষ

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.