দ্য এক্সর্সিস্ট কে পৃথিবীর সবচেয়ে অভিশপ্ত চলচ্চিত্র বলা হয়। এটিই অস্কার জয় করা প্রথম হরর মুভি।
অভিশপ্ত বলা হয় কারন ফিল্ম’টির নির্মান, প্রদর্শনী ও পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা ঘটেছিল দর্শক, ফিল্মের কাস্ট & ক্রো মেম্বারদের সাথে। পাশপাশি কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছিল।
সেই সব ঘটনা শুনানোর আগে জানানো উচিত এই ফিল্ম নির্মানে ব্যবহৃত সত্য ঘটনা’টি।
ফিল্মে দেখানো ঘটনাটি ১২ বছর বয়সী এক মেয়ের। কিন্তু আসল ঘটনা ঘটেছিলো ১৪ বছর বয়সী একটি ছেলের সাথে। যার আসল নাম ” রোনাল্ড ডো”। তার পরিচয় দীর্ঘদিন গোপন রাখা হয়। এবং এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে বানানো “Discovery”- চ্যানেলের ডকোমেন্টারীতেও তার মিথ্যে নাম (রিচার্ড) ” ব্যবহার করা হয়, ছেলেটির তথ্য গোপন করতে। যাইহোক, তার আসল নাম “রোনাল্ড ডো”৷
আসল ঘটনা
জানুয়ারি ১৯৪৯ সাল
রোনান্ডের পরিবারে বেড়াতে আসেন তার ফুফু হ্যারিয়েট। সাথে নিয়ে আসেন একটি OUIJA BOARD
(মৃতদের আত্মার সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম)
রোনাল্ড তার ফুফির সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলো। তাই তারা রাতের বেলা এই বোর্ডটি নিয়ে আত্মার সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করে। কোনো ফলাফল হয় না। কিছুদিন পর হ্যারিয়েট তার বাসায় ফিরে যায়। এদিকে রোনাল্ড-দের বাসায় রাতের বেলা কারো চলা ফেরার শব্দ ও পানি পড়ার শব্দ শুনা যায়৷
২৬ জানুয়ারী ১৯৪৯
সুস্থ সবল হ্যারিয়েটের হঠাৎ মৃত্যু হয়। একা ঘরে তার লাশ পাওয়া যায় বাথটবে ডুবন্ত অবস্থায়। তারপর থেকে রোনাল্ড-দের বাসায় রাতে হাটাহাটি,পানি পড়ার শব্দ বেড়ে যায়। দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলোও নিজে নিজে দোল খায় রাত হলেই। আসবাবপত্র ভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়।এসব রোনাল্ডের বাবা-মাও খেয়াল করেন।
২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৯
গভীর রাতে হঠাৎ রোনাল্ডের বিছানা কাপতে শুরু করে। যেনো কেউ বিছানার নিচ থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। শব্দ শুনে বাবা-মা রুমে আসেন। তারাও এ দৃশ্য দেখেন। কিন্তু বিছানার নিচে কেউ ছিলো না। রোনাল্ডের পিঠে কিছু কাটা দাগ দেখা যায়। হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। ডাক্তার’রা বলেন রোনাল্ডের মানসিক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তারা বাবা-মা নিজের চোখে দেখা ঘটনার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয় যে এটা প্যারানরমাল ঘটনা আর তারা ক্যাথলিক প্রিস্ট (পাদ্রী) ব্যাসপ র্যায়মন্ডের কাছে যান সাহায্য পেতে। র্যায়মন্ড জানান তার বন্ধু “ফাদার উইলিয়াম” কে। তারা বিস্তারিত তথ্য জেনে এক্সর্সিজম প্রক্রিয়া শুরু করেন।
উনারা দু’জন মন্ত্রপাঠ শুরু করেন। সাথে সাথে রোনাল্ডও পাঠ করে। রোনাল্ড সেসময় তাদের অসভ্য গালি-গালাজ করতে থাকে। এক সময় উইলিয়াম “গির্জার পবিত্র পানি” (Holly water) নিক্ষেপ করে রোনাল্ডের উপর। অবাক করা বিষয় হল, যেখানে যেখানে পবিত্র পানি ছিটা পড়ছে, সে সব স্থানে রোনাল্ডের শরীর কেটে যাচ্ছে। যেনো কেউ নখের আচড় দিয়ে শরীর কেটে ফেলছে ভিতর থেকে৷
এক সময় রোনাল্ড শান্ত হয়ে যায়। জানালা খোলে দিতে বলে। খোলে দেয়া হয়। রোনাল্ড ঘুম। তারা ভাবলেন রোনাল্ড ঠিক হয়ে গেছে। রাত ১টায় তারা বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বের হোন। রাত ৩ টা ১৫’তে আবার ফোন করে রোনাল্ডের পরিবার। র্যায়মন্ড ও উইলিয়াম ফিরে আসেন। জানতে চান কি হয়েছে।
পরিবার জানায় রাতে রোনাল্ড বাথরুমে যায়। দীর্ঘক্ষন ফিরে আসে না। চেক করতে মা যান সেখানে। দেখেন রোনাল্ড আয়নার দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে হাসছে আর নিজে নিজে কথা বলছে। আবারো এক্সর্সিজম শুরু করেন ফাদার উইলিয়াম। সারা রাতের চেষ্টায় শান্ত করেন রোনাল্ডকে কিন্তু ভিতরে সেই অশুভ শক্তি এখনো রয়ে গেছে। চারদিন চলে এভাবে এর মাঝে পাশের বাড়িগুলো থেকে অভিযোগ করে ঘুমের সমস্যার জন্য। ফাদার সিদ্ধান্ত নেন রোনাল্ডকে চার্চে নিয়ে গিয়ে এক্সর্সিজম করবেন। তা-ই করা হয়। এবার তারা জানতে পারে রোনাল্ডের ভিতর সাধারণ কোনো আত্মা নয়, তার ভিতর ডেভিলের বসবাস। এক্সর্সিজম চলাকালে রোনাল্ড খাতা-কলম খুজে। তাকে দেয়া হয়।
সে লিখে..
“I’m the Devil and i’ll give you a sign withing 13days”
ঠিক ১৩’তম দিনে রোনাল্ডের পেটে “প্যান্টাগনে”র চিহ্ন ভেসে উঠে। পাদ্রিরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় রোনাল্ডের ভিতর এক পবিত্র আত্মা প্রবেশ করাবো হবে ডেভিলের সাথে ফাইট করতে। তা-ই করা হয়। এর ফলে রোনাল্ড আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। শরীরে কাটা-ছেড়ার দাগ বেড়ে যায়। পাদ্রী’রা বেশ কিছুদিন “বাফটিজম” প্রক্রিয়ায় এক্সর্সিজম করে ডেভিলকে বশ করতে কিন্তু ফলাফল শূন্য। রোনাল্ডের ক্ষতের পরিমান আরো বেড়ে যায়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

এটি ক্যাথলিক হাসপাতাল। তাই হাসপাতালেও চালায় তার এক্সর্সিজম। এভাবে ২৮’বার তার উপর এক্সর্সিজম করা হয়। পাদ্রী ওয়াল্টারের বলেন, “রোলান্ডকে যখন বিছানার সাথে বেধে এক্সর্সিজম করা হত তখন এমনও হয়েছে যে বিছানাসহ মাটি থেকে উপরে উঠে যায় সে।” এভাবেই একদিন এক্সর্সিজম চলাকালে ডেভিল হার মেনে যায়। হাসপাতালের জেনারেটর ব্লাস্ট হয়ে যায় ডেভিল প্রস্থানকালে। ( ৪২ জন উপস্থিত ছিলেন তখন)
তারপর থেকে রোনাল্ড সুস্থ। তার পরিচয় গোপন রাখা হয়। ১৯৮৩ সালে ফাদার উইলিয়াম মারা যান। টিভি, মিডিয়া তাকে রোনাল্ডের ব্যাপারে প্রশ্ন করলেও তিনি কোনো তথ্য প্রকাশ করেন নি কখনো। সবশেষে এই ঘটনা সত্যটা জানায় সেই এক্সর্সিজমে অংশ নেয়া পাদ্রী/ফাদার ওয়াল্টার ১৯৯৩ ‘সালে “Discovery” চ্যানেলের কাছে।
বিঃদ্রঃ- রোনাল্ড ডো ১০’ই মে ২০২০’ এ মারা যান।
সিনেমাটি কে কেনো অভিশপ্ত বলা হয়?
ফিল্ম’টি তৈরি করা হয় লেখক William Peter Blatty এর বই “THE EXORCIST”-থেকে যা লেখক নিজে নিজে তথ্য সংগ্রহ করে এবং নিজের কল্পনা মিশিয়ে লিখেছিলেন। তাই আসল ঘটনার সাথে ফিল্মের কিছুটা অমিল রয়েছে।
চলুন সেই অদ্ভূত ঘটনাগুলো জানি
১) শুটিং চলাকালে দুই’বার শুটিং সেটে আগুন লাগে। একবার সার্কিট-বোর্ডে চড়ুই পাখি ঢুকে পড়ে আর আগুন লেগে যায়। আগুনে সব পুড়ে যায় কিন্তু ভৌতিক দৃশ্য যে ঘরে শুট করার কথা ছিলো সেটা অক্ষত থেকে যায়। আবার আগুন লাগে- এবার প্রজেস্ট মেয়ে রেগানের ভূমিকায় অভিনয় করা অভিনেত্রীর (লিন্ডা ব্লেইর) কিছুই হয় না। এমন কি জামাও পুড়ে না।
অথচ, তার সেখানে বাচার সম্ভাবনা’ই ছিলো না।

২) ডেভিলের কন্ঠ দেয়া ভোকালিস্টের (Mercedes McCambridge) ছেলে ও বউ নিজেদের গলা কেটে আ ত্ম হ ত্যা করে। এর কিছুদিন আগে তারা রাতে বাসায় কোনো ছায়ামূর্তি দেখার কথা জানিয়েছিলো।
আর তার ডেভিল ভয়েজের কন্ঠ নিয়েও ঝামেলা হয় Warner Bros এর সাথে তার। তাকে ফিল্মে ক্রেডিট দেয়া হয়নি। মামলা করেন এবং জরিমানা আদায় করেন।
৩) শুটিং সেটেও কোনো লম্বা ছায়ামূর্তি দেখা যেতো বলে জানা যায়। অনেক ক্রো মেম্বার কাজ ছেড়ে দেয়।
৪) ফিল্মের গল্প অনুযায়ী অভিনেতা ভ্যাসিলিকি ম্যালিরোস এবং জ্যাক ম্যাকগোরানের চরিত্রগুলো গল্প শেষ মারা যাবে। বাস্তব জীবনেও তারা দু’জনই ফিল্মটির শুটিং শেষে মারা যান।
৫) শুটিংয়ে আসার পথে অভিনেত্রী লিন্ডা গাড়ী এক্সিডেন্ট করে ৩’মাস হাসপাতালে পড়ে ছিলেন।
৬) ফিল্ম দেখার পর দর্শক’রা রাতে বাসায় কারো অস্তিত্ব অনুভব করা শুরু করে। অনেকে গির্জা গিয়ে নিজেদের পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করা শুরু করেন।
৭) একজন মেক-আপ আর্টিস্ট মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
৮) সিনেমাহলে একজন দর্শকের বাচ্চা হওয়ার ঘটনা।
মোট ৯’টি মৃত্যুর ঘটনার সাথে ফিল্ম’টিকে জড়ানো হয়। সে এক বিশাল বড় গল্প।
সেই সময়ের তুলনায় ফিল্ম’টি এতোটা ভয়ানক ছিলো যে বেশ কিছু দেশে ব্যান করে দেয়া হয়। যুক্তরাজ্যে ব্যান ছিলো ২৫ বছর। ১৯৯৯ সালে ব্যান মুক্ত করা হয়।
এতো কিছুর মাঝেও দ্য এক্সর্সিস্ট একটি সফল সিনেমা। সিনেমাটি তৈরি করতে সেই সময়ে ১২ মিলিয়ন ডলার ব্যায় হয়েছিল। আর আয় করেছিল ৪৪১ মিলিয়ন ডলার (১৯৭৩ সালে এই টাকার পরিমান কত বিশাল একবার চিন্তা করে দেখুন। এছাড়াও ফিল্মটি ২টি অস্কার-সহ ৪টি গোল্ডেন গ্লোব জয় করেছিলো ১৯৭৪ সালে।

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.