লুক ব্যাক ইন এংগার ব্রিটিশ নাট্যকার জন অসবর্ণের রচিত একটি বিখ্যাত নাটক, যা ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়। এই নাটকের মাধ্যমে জন অসবর্ণ আধুনিক নাট্যশালায় এক যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করেন। এই নাটকে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের পরিবর্তিত সমাজ ও তরুণ প্রজন্মের জীবন নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ধ্বংস ও ভয়াবহতার ফলে ব্রিটেনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়। অভিজাত ও ওয়ার্কিং ক্লাস অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের সাথে বৈষম্য বৃদ্ধি পায় অতি মাত্রায়। বিশেষত শিক্ষিত তরুণেরা তাদের জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। কারন তারা সমাজে নিজেদের জায়গা খুঁজে পাচ্ছিল না।

লুক ব্যাক ইন এংগার নাটকটিকে জন অসবর্ণেরই ব্যক্তিগত জীবনেরই প্রতিচ্ছবি মনে করা হয়। এই নাটকের প্রধান চরিত্র জিমি পটারের ব্যক্তিত্ব ক্ষোভ ও সম্পর্কের জটিলতা সবটুকুই নিজের জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত। নাটকে জিমি পটারেরর মতোই জন অসবর্ণের প্রথম স্ত্রী পামেলা লেন ছিলেন একজন সমাজের উঁচু শ্রেণীর পরিবারের একজন মেয়ে। তার ও তার স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়ন ও বিরোধ এই নাটকের প্রধান দুই চরিত্র জিমি ও অ্যালিসনের মাধ্যমে দেখিয়েছেন।
জন অসবর্ণ এই নাটকটিকে তিনটি অ্যাক্ট বা অঙ্কে ভাগ করেছেন। নাটকটি এক তরুণ দম্পতি অ্যালিসন ও জিমি পটারকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। যেখানে দেখা যায় ১৯৫০ এর দশকের ইংল্যান্ডে এই তরুণ দম্পতি সমাজের শ্রেণীগত সংঘাতে তাদের ভেঙে পড়া দাম্পত্য সম্পর্ককে সামলানোর চেষ্টা করছেন। যেখানে অ্যালিসন পটার বড় হয়েছেন ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী এক উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে। অপরদিকে অ্যালিসনের স্বামী জিমি পটার এসেছেন শ্রমজীবী শ্রেণির মাঝ থেকে। জিমি পটার শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের সাথে বেড়ে উঠলেও তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত তরুণ যুবক। এই তরুণ দম্পতি ইংল্যান্ডের মিডল্যান্ডের একটি অ্যাপার্টম্যান্টে বসবাস করেন। তাদের সাথে তাদের আরো এক বন্ধু ক্লিফ লুইস ও থাকেন। ক্লিফ সদালাপী ও শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষ একই সাথে সে জিমির দীর্ঘদিনের বন্ধু।
নাটকের শুরু হয় এক রবিবাের সকালে তাদের অ্যাপার্টম্যান্টে। অ্যালিসন তখন কাপড় ইস্ত্রি করছেন আর জিমি ও ক্লিফ সংবাদপত্র পড়ছেন। নাটকের প্রথম অংশের প্রায় পুরোটা সময় জিমির ক্রোধাত্মক বক্তৃতা দেখা যায়। আর সবটাই ছিলো সমাজের উচ্চবিত্তের প্রতি তার রাগ ও ক্রোধ। আর সেই রাগ ও ক্রোধ তিনি বেশিরভাগই অ্যালিসনের পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বলেন। জিমি মনে করেন জীবনের আসল মানে বুঝবার জন্য জীবনে দুঃখ, কষ্টের প্রয়োজন কিন্তু অ্যালিসনের মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষের পক্ষে সেই সুখ ও মানে বুঝা সম্ভব না। কারন তারা সবসময় প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছে। দুঃখ ও কষ্ট তাদের জীবনকে তেমন স্পর্শ করতে পারে না।

জিমি মনে করেন তার স্ত্রীর মধ্যে আবেগ নেই। আর তাই তিনি তার স্ত্রীকে তার পরিবার নিয়ে আক্রমণাত্মক কথা বলে ক্রমাগত উত্তেজিত করবার চেষ্টা করতে থাকে। জিমির বন্ধু ক্লিফও জিমিকে খুশি করার জন্য সেই মজায় অংশ নেয়। আর সেই হাসাহাসি ও ঠাট্টার এক সময় তারা অ্যালিসনের ইস্ত্রি করা টেবিলের সাথে ধাক্কা খায়। এর ফলে ইস্ত্রিতে অ্যালিসনের হাত পুড়ে যায়। জিমি এজন্য দুঃখ প্রকাশ করে। কিন্তু অ্যালিসন রাগ করে তাকে চলে যেতে বললে জিমি সেখান থেকে চলে যায়।
জিমি চলে যাবার পর ক্লিফ অ্যালিসনের হাতের পোড়া স্থানে প্রাথমিক চিকিৎসার কাজে সাহায্য করেন। অ্যালিসন তখন ক্লিফকে জানায় সে এখন জিমির সন্তানকে তার গর্ভে ধারণ করছেন। তবে এই কথা তিনি এখনো জিমিকে জানান নি। কারণ এই কথা শুনলে হয়তো জিমি আরো ক্রুদ্ধ হয়ে পড়বে। ক্লিফ তখন অ্যালিসনকে সান্তনা দেয় এবং বুঝায় যে জিমি তাকে ভালেবাসে। এরপর ক্লিফ এলিসনকে একটি চুমু খায়। এসময় জিমি ঘরে ঢুকে তাদের দুজনের চুম্বন দৃশ্য দেখতে পেলেও জিমি কেনোরকম প্রতিক্রিয়া বা আপত্তি দেখায় না।
কিছুক্ষণ পর ক্লিফ সিগারেট আনতে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়, আর তখন অ্যালিসন ও জিমির মধ্যে এক মৃদু আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়। তারা তাদের Bear and Squirrel খেলা খেলে, যা তাদের বাস্তবতা ভুলে একে অপরের সান্নিধ্যে ভালোবাসায় মগ্ন হতে সাহায্য করে। এর কিছুক্ষণ পর ক্লিফ ফিরে আসে এবং জানায় যে অ্যালিসনের উচ্চবিত্ত বান্ধবী হেলেনা চার্লস ফোন করেছে। সঙ্গে সঙ্গে জিমির মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অ্যালিসন জানায় যে হেলেনা কিছুদিন তাদের সঙ্গে থাকতে চায়। এই কথা শুনে জিমি রেগে যায়। কারন সে অভিজাত সমাজের মানুষদের দেখতে পারে না। এর মধ্য দিয়ে নাটকের প্রথম অঙ্ক শেষ হয়।
নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের শুরু হয় হেলেনা ও অ্যালিসনকে ঘরের বিভিন্ন কাজ করতে দেখানোর মাধ্যমে, আর জিমি পটার তখন পর্দার আড়ালে ট্রাম্পেট বাজাচ্ছে। অ্যালিসন তখন হেলেনাকে তাদের বৈবাহিক জীবনের শুরুর দিনগুলোর কথা বলে। সে জানায় যে তারা প্রথমে জিমির শ্রমজীবী বন্ধু হিউ ট্যানারের সঙ্গে থাকত এবং নিয়মিত অ্যালিসনের উচ্চবিত্ত বন্ধুদের পার্টিতে গিয়ে হাঙ্গামা করত। অ্যালিসন বলে, সে নিজেকে তখন এমন এক বন্দি মনে করত, যে সেই সমাজের অংশ থেকে এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে জিমি ও তার বন্ধুরা একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
হেলেনা জানতে চায় এমন বিরুদপূর্ণ সম্পর্কের মাঝেও তারা কেন বিয়ে করেছিল। উত্তরে অ্যালিসন বলে, এটি অনেকটাই ঘটেছিল তার মা ও বাবা কর্নেল রেডফার্নের প্রবল আপত্তির কারণে। তাদের নিষেধাজ্ঞাই জিমিকে যেকোনো মূল্যে অ্যালিসনকে বিয়ে করতে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছিল।
জিমি ও ক্লিফ খেতে আসে। যখন সে শুনতে পায় যে হেলেনা ও অ্যালিসন পরে একসঙ্গে গির্জায় যাবে, তখন সে আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে হেলেনা অ্যালিসনকে তার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যেতে চায়। জিমি তখন অ্যালিসনের মায়ের বিরুদ্ধে একের পর এক অবমাননাকর মন্তব্য ছুড়ে দেয়। হেলেনা তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। সে সময়ে জিমি চার্চ ও ধর্ম নিয়ে আক্রমনাত্মক কথা বলে। জিমি জানায় যে ধর্মের মাধ্যমে তিনি কখনও সান্ত্বনা পাননি এবং এই সবকিছুই তার কাছে অর্থহীন মনে হয়।
এরপর জিমি হেলেনাকে জিজ্ঞেস করে, সে কি কখনো কাউকে মারা যেতে দেখেছে? তখন জিমি তার শৈশবের কথা বলে। জিমি বলে যখন তার বয়স মাত্র দশ বছর তখন সে তার বাবার মৃত্যু সামনে থেকে দেখেছে। তার বাবা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। জিমির দাবি, এই ঘটনাই তাকে জীবনের প্রকৃত শিক্ষা দিয়েছে, যা হেলেনা ও অ্যালিসন এখনও জানতে ও বুঝতে পারে নি। এই দৃশ্যের শেষের দিকে জিমি ফোন করতে বাইরে যায়। সে বেরিয়ে যাওয়ার পর হেলেনা অ্যালিসনকে জানায় যে সে কর্নেল রেডফার্নকে খবর পাঠিয়েছে, তিনি বলেছেন যে তিনি শীঘ্রই অ্যালিসনকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন। অ্যালিসন এই কথা শুনে কোনো আপত্তি করে না।
জিমি অ্যাপার্টম্যান্টে ফিরে এসে জানায় যে হিউ টেনারের মা—যে শ্রমজীবী নারী জিমিকে ক্যান্ডির দোকান খোলার জন্য সাহায্য করেছিল এবং যার প্রতি জিমি গভীর ভালোবাসা অনুভব করে তিনি স্ট্রোক করে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। জিমি তখন অ্যালিসনকে অনুরোধ করে, যেন সে তার সঙ্গে হাসপাতালে যায়। কিন্তু অ্যালিসন গির্জায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পরবর্তী দৃশ্যে দেখা যায় অ্যালিসনের বাবা কর্নেল রেডফার্ন অ্যালিসনকে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে সাহায্য করেন। তিনি স্বীকার করেন যে তিনি ও অ্যালিসনের মা জিমির সঙ্গে তার বিয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন এবং জিমির তাদের প্রতি রাগ করার কারণ থাকতে পারে। তিনি বলেন, জিমির বক্তব্য হয়তো সত্যি—তিনি নিজেই এক পুরনো ইংল্যান্ডের অবশিষ্টাংশ, যা এখন অস্তিত্বহীন। অ্যালিসন তার কাছ থেকে এমন কথা শুনে অবাক হয় এবং জিনিসপত্র গুছানোর সময় কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়। এরপর হেলেনা আসে, আর অ্যালিসন চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করে। অ্যালিসন নিজেই চাইছিলো জিমির থেকে দূরে গিয়ে তাদের সম্পর্ককে কিছুটা স্বাভাবিক করতে।
কিছুক্ষণ পর জিমি ফিরে আসে এবং প্রচণ্ড রেগে যায়। কারণ সে দেখতে পায় যে অ্যালিসন তার বাবার সঙ্গে চলে গেছে। হেলেনা তাকে অ্যালিসনের লেখা একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে অ্যালিন জিমিকে তার প্রতি করা মানসিক অত্যাচার ও চরম অবজ্ঞার কথা বলেন। জিমির আচরণের প্রতি সে অসহ্য হয়ে উঠেছে একই সাথে সেই আচরণে সে ক্লান্ত। এইসব কথা শুনে জিমি আরোও রেগে যায়। হেলেনা তখন জিমিকে জানায় যে অ্যালিসন গর্ভবতী। কিন্তু জিমি তাতে আবেগপ্রবণ হয় না; বরং সে হেলেনাকে অপমান করে। এতে রেগে গিয়ে হেলেনা তাকে চড় মারে। জিমি তখন হতাশায় ভেঙে পড়ে। তারপর হেলেনা হঠাৎ করেই তাকে গভীরভাবে চুমু খায় আর এখানেই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের সমাপ্তি হয়।
নাটকের এর পরের দৃশ্য দেখা যায় কয়েক মাস পরে। যেমনটা নাটকের প্রথম দৃশ্যে ঘটতে দেখা যায়। দুই বন্ধু সংবাদপত্র পড়ছেন আর বিভিন্ন মন্তব্য করছেন তবে এবার টেবিলে অ্যালিসনের জায়গায় কাপড় ইস্ত্রি করছেন হেলেনা। জিমি ও ক্লিফ মজা করতে করতে সংবাদপত্রের খবর নিয়ে আলোচনা করে। তারা দুষ্টুমি করতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে, আর এতে ক্লিফের শার্ট নোংরা হয়ে যায়।
হেলেনা সেই নোংরা শার্টটি ধুতে চলে যায়। তখন ক্লিফ জিমিকে জানায় সে শীঘ্রই এই অ্যাপার্টম্যান্ট ছেড়ে চলে যাবে। জিমি তখন তাকে কড়া ভাষায় বলেন, “You can’t leave. You’re the only one who is still with me.” হেলেনা শার্ট নিয়ে ফিরে আসে, আর ক্লিফ সেটি শুকানোর জন্য তার ঘরে নিয়ে যায়।এরপর হেলেনা জিমিকে বলে যে সে তাকে ভালোবাসে। উত্তরে জিমি মরিয়া হয়ে তাকে অনুরোধ করে যেন সে কখনো তাকে ছেড়ে না যায়। ঠিক তখনই দরজায় এসে উপস্থিত হয় অ্যালিসন, অসুস্থ ও বিধ্বস্ত চেহারায়।
নাটকের পরবর্তী দৃশ্য শুরু হয় এর কয়েক মিনিট পর জিমি তখন ট্রাম্পেট বাজাচ্ছে। অ্যালিসন হেলেনাকে জানায় যে সে তার ওপর রাগান্বিত নয় এবং তাদের নতুন সম্পর্ক ভাঙার কোনো ইচ্ছা তার নেই। কিন্তু হেলেনা বলে যে অ্যালিসনের উপস্থিতি তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে সে যা করছে তা ভুল করেছে। সে অ্যালিসন ও জিমির মাঝ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে।
অ্যালিসন জানায় সে তার অনাগত সন্তানকে হারিয়েছে। হেলেনা এটিকে তার সম্পর্কের ওপর একপ্রকার ‘বিচার’ বলে মনে করে। এরপর সে জিমিকে ডেকে পাঠায় এবং জানায় যে সে চলে যাচ্ছে।জিমি বলে যে, সে শুরু থেকেই জানত হেলেনা প্রকৃত ভালোবাসার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, কারণ সত্যিকারের ভালোবাসার জন্য ‘শারীরিক ও মানসিক শক্তি’ দরকার। এরপর হেলেনা চলে যায়। অ্যালিসন জিমির সামনে আত্মসমর্পণ করে, তার দুঃখ ও কষ্টের কথা জানায়। সে বলে, “I can’t be as brave as you are. I’m not brave. I just came back.”
জিমি তাকে এই অবস্থায় সহ্য করতে পারে না এবং তাকে সাহায্য করতে হাঁটু গেড়ে বসে। এরপর, এক ধরনের বিদ্রূপাত্মক কিন্তু স্নেহময় ভঙ্গিতে, সে তাদের Bear and Squirrel খেলায় ফিরে যায়। জিমি অ্যালিসনকে বলেন Poor squirrels, আর অ্যালিসন তার জবাবে ফিসফিস করে বলেন Oh poor, poor, bears.

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.