ইংরেজি সাহিত্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের আবির্ভাব না হলে তিনিই হয়তো হতেন ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। বলছিলাম ইংরেজি নাট্যজগৎ এর বলিষ্ঠ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লোর কথা।
ক্রিস্টোফার মার্লোর জন্ম ১৫৬৪ সালে ইংল্যান্ডের ক্যান্টরবেরী শহরে। সেইন্ট জর্জ গির্জার রেজিস্টারে ক্রিস্টোফার মার্লো সম্পর্কে লেখা আছে, ‘The 26th day of February was christened Christopher,the sonn of John Merlow. অর্থাৎ ধরে নেয়া যেতে পারে ১৫৬৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতেই মার্লোর জন্ম। মার্লোর বাবা ছিলেন একজন চর্মকার এবং মা সম্পর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না, অন্যান্য ৮/১০ জন নারীর মতো তিনিও হয়তো গৃহিণী ছিলেন।
ক্রিস্টোফার মার্লো তার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করেন ক্যান্টরবেরীর একটি অতি সাধারণ ও অখ্যাত একটি স্কুল থেকে। ১৫ বছর বয়সে মার্লো King’s Grammar School এ ভর্তি হন। এএই স্কুলে প্রতিবছর ৫০ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিতো। ক্রিস্টোফার মার্লো সেই বৃত্তি অর্জন করেছিলেন। এই বৃত্তি ছিল ৬ বছর মেয়াদী ফলে পড়াশোনা নিয়ে সংসারের টানাপোড়েনের মুখোমুখি হতে হয়নি মার্লোকে।
স্কুলের পড়াশোনা শেষে ক্রিস্টোফার মার্লো Corpus Christi College এ ভর্তি হন। এই কলেজে পড়াশোনার সময়ে মার্লো টুকিটাকি লেখালেখি শুরু করেন, এবং বেশ কিছু বিখ্যাত গ্রন্থ অনুবাদ ও করেছিলেন। মার্লো ১৫৮৪ সালে ব্যাচেলর অব আর্ট ডিগ্রি অর্জন করেন।
এই কলেজে পড়াশোনা করাকালীন সময়ে মার্লো ফ্রান্সে গুপ্তচর বৃত্তি করতেন এবং প্রায়শই ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতেন। এই কথা কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছে যায় এবং তারা অনেক দিনের জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে মাস্টার্স অব আর্টস ডিগ্রি দেওয়া থেকে বিবর ছিলো। অবশেষে ১৫৮৭ সালে ক্রিস্টোফার মার্লো মাস্টার্স অব আর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছোটবেলা থেকে ক্রিস্টোফার মার্লোর ইচ্ছে ছিলো পাদরি হওয়ার। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি হয়ে উঠলেন ঘোরতর নাস্তিক। স্রষ্টার অস্তিত্বে তিনি ছিলেন সন্দিহান এবং গ্রহণ করলেন প্রাচীণ গ্রীক মনিষীদের সেই তত্ত্ব!
“মানুষই তার ভাগ্যকে গড়ে তোলে, নিয়ন্ত্রণ করে; স্রষ্টা নয়।”
১৮৮৮ সালে মার্লো লন্ডন শহরে পাড়ি জমান। লন্ডন শহরে যাওয়ার পর তার সেখানকার তৎকালীন জ্ঞানী ও প্রভাবশালী মানুষদের সাথে পরিচয় হয়।
লন্ডন শহরে যাওয়ার পর মার্লো অভিনেতা হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার এমনই দূর্ভাগ্য যে মঞ্চে অভিনয় করতে গিয়ে দুর্ঘটনাক্রমে নিজের পা খানাই ভেঙে বসেন। ফলে অভিনয় জীবনের ইতি ঘটে এখানেই।
অভিনয় করতে না পারলেও অভিনয়ের সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিলেন মার্লো আর তাই নিজেকে আত্মনিয়োগ করলেন নাটক রচনায়। একের পর এক নাটক লিখতে থাকেন ক্রিস্টোফার মার্লো, আর সেগুলো মঞ্চস্থ হতে থাকে। Tumberlain the great নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৫৮৮ সালে এরপর The Jew of Malta, Doctor Faustus, Edward II সহ আরো অনেক নাটক।
১৫৮৯ সালে ক্রিস্টোফার মার্লো একটি বড়সড় ঝামেলায় পড়ে যান। উইলিয়াম ব্রাডলি নামের এক লোকের সঙ্গে মার্লো তর্কে জড়িয়ে পড়েন। একটা সময় সেই তর্কবিতর্ক মারামারিতে রূপ নেয়। মার্লোর বন্ধু টম ওয়াটসন সেই তাকে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন এবং ব্রাডলিকে আঘাত করেন। ওয়ারসনের আঘাতে ব্রাডলির তৎক্ষনাৎ মৃত্যু হয়। পুলিশ ওয়াটসন ও মার্লো দুজনকেই গ্রেফতার করে। দীর্ঘ ১৩ দিন কারাগারে থাকার পর মুক্তি পান ক্রিস্টোফার মার্লো।
১৫৯৩ সালে ইংল্যান্ডে তখন প্লেগ মহামারী হানা দিয়েছে। ফলে প্রায় সব নাট্যশালাই বন্ধ হয়ে যায়। সেসময়কার আরেকজন বিখ্যাত নাট্যকার ছিলেন টমাস কিড। তার লেখা দ্য স্প্যানিশ ট্রাজেডি নামে একটি বিখ্যাত নাটক ও রয়েছে। সেসময় ইংল্যান্ড পুলিশ টমাস কিডের বাড়িতে তল্লাশি চালায় এবং একটি পান্ডুলিপি খুঁজে পায়। পান্ডুলিপিটির শিরোনাম ছিলো ‘Denyinge the deity of jesusus christ our savior. এই বইটি ছিলো খ্রিস্টান ধর্মের সমালোচনা নিয়ে লেখা। কিডস বলেন এটি তার লেখা নয়, এটি মালিক ক্রিস্টোফার মার্লো।
ফলে ধর্ম অবমাননার জন্য আরো একবার কারাগারে যেতে হয় ক্রিস্টোফার মার্লো কে। তবে খুব দ্রুতই জামিনে মুক্তি পান ক্রিস্টোফার মার্লো। সেসময় এই ঘটনা তদন্ত করার জন্য পুলিশ রিচার্ড বেইন্স নামের একজন গোয়েন্দা কে নিয়োগ করে।
২৯ মে ১৫৯৩ সালে রিচার্ড বেইন্স একটি রিপোর্ট জমা দেন ক্রিস্টোফার মার্লো সম্পর্কে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ক্রিস্টোফার মার্লো শুধু নাস্তিকই নন! তিনি যেখানে যান সেখানেই মানুষকে নাস্তিক হতে প্ররোচিত করেন। বেইন্স আরো উল্লেখ করেন মার্লোর সাথে আরো বেশ কিছু প্রভাবশালী লোকজনও এসবের সাথে জড়িত আছে, খুব শীঘ্রই তাদের নামও উন্মোচন করা হবে। কিন্তু দূর্ভাগ্য তার আগেই ক্রিস্টোফার মার্লো পরপারে চলে যান।
সময়টা ৩০ মে ১৫৯৩,
এক পানশালায় মদ্যপ অবস্থায় ইনগ্রাম ফিজার নামের এক মাতালের ছুরিকাঘাতে নিহত হন প্রভাবশালী নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লো। সেই খুনের সময় মাত্র ২ জন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো। তবুও সেই হত্যাকারীর বিচার হয়নি।
সরকারি পুলিশের ভাষ্যে বলা হয় কে বিল পরিশোধ করবে তা নিয়ে মার্লো ও ফ্রিজারের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয় এবং আত্মরক্ষার্থে ফ্রিজার মার্লো কে হত্যা করেন। আর তাই ফ্রিজারের অপরাধ ক্ষমাযোগ্য।
পুরো ঘটনাটিই আসলে সাজানো, মূলত ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারনে সরকার ও চার্চের ষড়যন্ত্রের ফলেই অকালে চলে যেতে হয়েছিল মার্লো কে। খুব বেশিদিন বাঁচেন নি। আয়ুষ্কাল মাত্র ৩৮ বছর! আর লিখে গেছেন খুবই কম।
তবুও এই অল্প সাহিত্যকর্ম দিয়েই তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অমর হয়ে নিজের উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন।
Very interesting