তিথিডোর উপন্যাসটি বুদ্ধদেব বসুর একটি বিখ্যাত উপন্যাস যা ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিবর্তনমুখী সমাজমানসের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে এ-উপন্যাস। সত্যেন ও স্বাতীর প্রেম-আখ্যানের অন্তরালে এখানে প্রতিভাসিত হয়েছে চল্লিশের দশকের বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজজীবনের নানামাত্রিক চিত্র।
“তিথিডাের” উপন্যাসে একান্নবর্তী পরিবারজীবনের প্রতিস্নিগ্ধ সম্পর্কের স্পর্শ আছে, আছে জীবনের প্রসন্নপ্রান্তরের হাতছানি। তবে একই সঙ্গে বিপ্রতীপ একটি প্রবণতাও এ-উপন্যাসের অন্তস্রোতে প্রবহমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর বিপন্ন-বিচূর্ণ সময় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তিথিডাের উপন্যাসের প্রধান সব চরিত্র। স্বৈরবৃত্ত-কালের অমােঘ নির্দেশে রাজেনবাবু, বিজন, শাশ্বতী, স্বাতী, হারীত, সত্যেন, প্রবীর— ‘তিথিডাের’-এর এইসব মানুষ, কখনাে হয়ে উঠেছে একাকিত্বের উপাসক, কখনাে নৈঃসঙ্গ্যপূজারী, কখনাে-বা তারা করেছে নির্বেদ-নিরানন্দের আরাধনা।
১#
মন খারাপ মানুষের কখন লাগে আর কেন লাগে তার কি কোনো নিয়ম আছে? কিছুর মধ্যে কিছু না- সব ঠিক- সব ভাল… হঠাৎ শ্রীযুক্ত মন খারাপ এসে হাজির হলেন, যেন আর নড়বেন না এখান থেকে। তা লোক কিন্তু উনি তত খারাপ নন, মানে- মন খারাপ হওয়াটাই যে খারাপ তা কিন্তু ঠিক না। আমার তো বেশ ভালই লাগে এক এক সময়।
২#
পৃথিবীকে না হলে এক মুহূর্ত চলে না আমার, কিন্তু আমাকে না হলে পৃথিবী তো চলবে চিরকাল।
৩#
ছড়ানো জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে স্বাতি বলল- আচ্ছা বাবা, সকলের জন্যই আনলে, নিজের জন্য তো কিছু আনলে না?
নিজের জন্যই তো সব এনেছি- বললেন রাজেনবাবু।
৪#
আবছা চেতন ভালো লাগাটা দুজনেই মেনে নিল নিঃশব্দে – নিজেরটা আর অন্যজনেরটাও। এর আগে তারা কথা বলেনি বলবার কিছু নেই বলে আর এখন বললো না যেহেতু দরকার নেই।
৫#
পুরোনো সহপাঠীদের কারো কারো সঙ্গে এখনও তার দেখা হয় মাঝে-মাঝে। তারা প্রত্যেকেই তাকে বলে-করছ কী হে, ঐ একটা রদ্দি কলেজেই পচবে নাকি? উত্তরে সত্যেন শুধু বলে বেশ আছি। কথাটা ভান নয়, স্তোক নয়, সত্যি সে যা বিশ্বাস করে তা-ই সে বলে। কত ভাল আছে, কত সুখে আছে, তা কি এরা বোঝে না? কলকাতায় আছে, অল্প কাজ, লম্বা ছুটি, নিজের ছাড়া আর কারো ভার নেই, বলতে গেলে কোনও ভারই নেই, কেননা তার নিজের খুব অল্পেই চলে যায়। কলেজে পায় একশো কুড়ি টাকা, একটি (একটিই মাত্র) টুশনি করে সেই সঙ্গে। সবসুন্ধু যা পায় তাতে ভেসে যায় তার। বই কেনা, দেশ দেখা সবসুন্ধু। এর বেশি আয় হলে তা নিয়ে কী করবে তা প্রায় ভেবে পাওয়াই মুশকিল। আর, আয় বাড়াবার কথাও অবশ্য ওঠে না, যদি না সে রাজী হয় অবসর বেচতে, স্বাধীনতা বিকোতে। আর তার কাছে যা আসল, সবচেয়ে যা মূল্যবান, তা-ই যদি না থাক তাহলে অন্য কোনো কিছুই কোনো কাজে লাগবে না তো!
৬#
মন খারাপ হওয়াটাই যে খারাপ তা কিন্তু ঠিক না। আমার তো বেশ ভালই লাগে এক এক সময়।
৭#
সব সময়ই আমাদের চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। যেটা আছে, হচ্ছে, সেটা আমাদের কাছে কিছুই না; আমাদের সুখের সময়গুলিকে আমরা বুঝতে পারি, তখন-তখন না, পরে—অনেক পরে; আর তাই সব সময় মনে হয় যা হয়ে গেছে তার মতো আর হল না, হবে না—এটা অবশ্য একটু হেসে জুড়ে দিল—আমার নিজের কথা না, নতুনও না, কিন্তু পুরোনোকেই নতুন লাগে যখন সেটা জীবন দিয়ে বুঝি।
৮#
কবে আসবেন? ছুটি-তো প্রায় শেষ, আর আসতেই তো হবে। চিঠিই আর চাই না। চিঠি আর ভালো লাগে না। এর উত্তরে আসবেন।
৯#
দুঃখ বাইরে থেকে আসে আর মন খারাপ টা নিজের মধ্যে জন্মায়। মন খারাপেরও সুখ আছে, ওটা যেন সুখেরই ছড়িয়ে পড়া চেহারা। সুখ জ্বলজ্বলে রঙ, সূর্যাস্তের আকাশের মত, এখানে লাল ওখানে সোনালী, আরো দূরে হলদে। কিন্তু মাঝে ফাঁকা অনেকটাই ফাঁকা। তারপর ওসব যখন মুছে যায় আর সমস্তটা আকাশ জুড়ে কেবল একটা ছায়া রঙ ছাই রঙ না রঙ থাকে, মনখারাপ ও সমস্ত মন ভরে সেইরকম। আর দুঃখ? যাতে গলা শুকোয়, কথা ফোটেনা ভয় করে।
১০#
যেটা নেই, সেটাই আমাদের মনে পড়ে। যেটা আছে সেটাতো আছেই।
১১#
লম্বা জ্বলজ্বলে গ্রীষ্মের গুনগুন দিন গুলির অনেক খানি ভরে গেল চিঠি পাওয়ায় চিঠি লেখায় আর চিঠি ভাবায়।
১২#
দুঃখ তো সেটাই, যা মানুষকে একলা করে দেয়। সকলে মিলে অনেকে মিলে দুঃখী হওয়া যায় না তো।

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.