হাসান বসরি’র পুরো নাম আল হাসান ইবনে আবিল হাসান আল বসরি। তার জীবনকাল ৬৪২ – ৭২৮ খ্রীস্টাব্দ। হাসান বসরি ছিলেন একজন প্রখ্যাত মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক।তিনি পারস্য বংশোদ্ভুত পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন; আর বড় হয়েছিলেন উম্মে সালামার ঘরে। হাসান বসরী তার জীবদ্দশায় অনেক সাহাবির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বলা হয় থাকে যে, বদর যুদ্ধে সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণকারী সত্তরজন সাহাবীর সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন। সুফি সাধনার দিক দিয়ে তিনি হযরত আলীর অনুসারী ছিলেন।
হাসান বসরি ছিলেন তার প্রজন্মের অন্যতম প্রভাবশালী সুফি ব্যক্তিত্ব । তিনি ১১০ হিজরি সালের ৫ রজব তারিখে ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সমগ্র বসরার প্রায় সকল মানুষ তাঁর জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন। এই কারণে আসরের নামাজের সময় বসরার জামে মসজিদ খালি ছিল। বসরার ইতিহাসে এমন ঘটনা ছিল এটাই প্রথম। অন্যান্য সুফি সাধকদের কাছেও তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব সমসাময়িক সুফি সাধকদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই ব্লগে হযরত হাসান আল বসরী (রহঃ) এর ৪০ টি অসাধারণ বাণী ও উপদেশ তুলে ধরেছি পাঠকদের সামনে।
১
আমি এমন মানুষ দেখেছি, যাদের জন্যে এই দুনিয়া তাদের পায়ের নিচের ধুলো থেকেও তুচ্ছ। আমি এমন মানুষ দেখেছি যারা দিনশেষে শুধুমাত্র তাদের নিজের অংশের খাবারটুকু জোগাড় করতে পারতেন, তবুও তারা বলতেন, “আমি এর সবটুকু দিয়ে নিজের উদরপূর্তি করব না। আমি অবশ্যই এর কিছু অংশ আল্লাহর ওয়াস্তে দান করব।” এরপর তারা তাদের খাবারের কিছু অংশ দান করে দিতেন যদিও গ্রহণকারীর চেয়ে ওই খাবারটুকু তাদেরই বেশি প্রয়োজন ছিল।
২
নিবিড় নির্জন চিন্তায় যার মন আল্লাহকে জানতে না পারে, সে নিশ্চয় পার্থিব জীবনের প্রতি মোহাচ্ছন্ন।অথবা অলস। আর যার দৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর রহস্যময়তার আভাস নেই, তারও দৃষ্টি জাগতিক ধুলাবালির দ্বারা আচ্ছন্ন।.
৩
আমি কেবল আল্লাহর স্বানিধ্য তথা জান্নাত চাই। মানুষ থেকে নিরাপত্তা নয়। এদের জিহ্বা থেকে স্বয়ং আল্লাহও রেহাই পাননি।
৪
আমরা হাসি-ঠাট্টা করি, কিন্তু কে জানে– হয়তো আল্লাহ আমাদের কিছু কাজকর্ম দেখে বলছেন: “আমি তোমাদের কাছ থেকে কোনো আমলই গ্রহণ করব না।
৫
যদি স্বয়ং আল্লাহ আপনার সঙ্গে থাকেন আর আপনার পূর্ণ আস্থা অটুট থাকে, তাহলে আর ভাবনা কিসের? আর এ কথায় যদি আপনার আস্থা না থাকে তাহলে অন্যের উপদেশে কোনো ফল হবে না।
৬
পৃথিবীর জীবনটা তিনটি দিনের–
গতকালের দিনটিতে যা করা হয়েছে সেগুলো নিয়ে সেটি চলে গেছে;
আগামীকালের দিনটিতে হয়ত আপনি না-ও পৌছতে পারেন;
কিন্তু আজকের দিনটি আপনার জন্য সুতরাং যা করার আজই করে নিন।
৭
বুদ্ধিমান ব্যক্তির জিহবা তার হৃদয়ের পেছনে থাকেঃ সে যখন কথা বলতে চায়, প্রথমে সে চিন্তা করে। যদি শব্দগুলো তার জন্য কল্যাণকর হয় তাহলে সে তা বলে। আর যদি কথাগুলো তার জন্য অকল্যাণকর হয় তাহলে সে চুপ থাকে। একজন মূর্খ ব্যক্তির জিহবা তার হৃদয়ের সামনে থাকেঃ সে কথা বলার সময় খুব কমই চিন্তা করে এবং তার জন্য কল্যাণকর বা অকল্যাণকর যা-ই হোক সে বলে ফেলে।
৮
আমি সেসব মানুষদের (সালাফদের) দেখেছিলাম তারা তাদের দিরহাম ও দিনারের (অর্থাৎ, তাদের টাকার) চেয়ে সময়ের প্রতি অনেক বেশি যত্নবান ছিলেন।
৯
তওরাতে আছে, যে ব্যক্তি অল্পে তুষ্ট হওয়ার অভ্যাস করেছে, সে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে বেঁচে গিয়েছে।
১০
হে আদমের সন্তানেরা! পৃথিবীর মাটির উপরে যতক্ষণ ইচ্ছা করে হেঁটে নাও কেননা খুব শীঘ্রই সেটা তোমার কবরে পরিণত হয়ে যাবে। মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে তো তোমার জীবনের আয়ু কমে যাওয়াকে তুমি ঠেকিয়ে রাখতে পারনি।
১১
কম বয়সে কোন কিছু শেখার প্রভাব অনেকটা পাথরের উপরে খোদাই করে লেখার মতন।
১২
দুনিয়ার প্রতি তীব্র আসক্তির ফলেই হৃদয়-মনের মৃত্যু ঘটে।
১৩
তোমাদর আগে পৃথিবীতে যারা ছিলেন তারা মনে করতেন মৃত্যু তাদের সন্নিকটে। তাদের একেকজন পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানি সংগ্রহ করে নিতেন, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেন এবং তারপর ওযু করতেন আল্লাহর নির্দেশের (মৃত্যু) ভয়ে যেন তা এমন অবস্থায় না আসে যখন তিনি পবিত্র অবস্থায় নেই।
১৪
মানুষের সংশ্রব যে এড়াতে পেরেছে, সে প্রকৃত পথের সন্ধান পেয়েছে।
১৫
মানুষ ছাগল ভেড়ার চেয়েও অসাবধান। রাখালের ডাক শুনে পশুরা ঘাস খাওয়া ছেড়ে তার কাছে ছুটে যায়। মানুষ তার প্রতিপালকের আহ্বানে কর্ণপাতই করে না।
১৬
নিকৃষ্ট তো সেই মৃতব্যক্তির পরিবারের মানুষগুলো, যারা মৃত মানুষটির জন্য কান্নাকাটি করে অথচ তার রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করে না।
১৭
যে প্রবৃত্তিকে বশীভূত করেছে, সে স্বাধীনতা লাভ করেছে।
১৮
একজন মু’মিনের যত গুণাবলী রয়েছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো ক্ষমাশীলতা।
১৯
সালাফগণ রাতে সলাতে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং দিনের বেলা কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী আমল করতেন।
২০
যে হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগ করেছে, সে বন্ধুত্ব অর্জনের উপযুক্ত হয়েছে।
২১
হে আদমের সন্তানেরা! পৃথিবীর মাটির উপরে যতক্ষণ ইচ্ছা করে হেঁটে নাও কেননা খুব শীঘ্রই সেটা তোমার কবরে পরিণত হয়ে যাবে। মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে তো তোমার জীবনের আয়ু কমে যাওয়াকে তুমি ঠেকিয়ে রাখতে পারনি।
২২
অন্তরে বাহিরে অমিলই হলো প্রবঞ্চনার লক্ষন।
২৩
তিনিই প্রকৃত বিশ্বাসী যিনি আল্লাহর শপথ করে বলতে পারেন তিনি বিশ্বাসী।
২৪
যিনি ধীরস্থির, সাধনায় দিন যাপন করেন আর অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন না, তিনিই প্রকৃত বিশ্বাসী।
২৫
আল্লাহ্-ভীতির লক্ষণ তিনটি: ১/ যার মনে আল্লাহর ভয় আছে, সে রেগে গেলেও বা স্বাভাবিক অবস্থায়-সবসময় সত্য কথা বলে।
২/ যে বিষয়ে আল্লাহ্ খুশি নন, সে বিষয়ে মন্দ রিপুগুলোকে তিনি দমন করে রাখেন।
৩/যে কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, সে কাজেই শুধু ব্যস্ত থাকেন।
২৬
পার্থিব আসক্ত মানুষ তিনটি আক্ষেপ নিয়ে কবরে যায়। ১.ধনের উপার্জন ও সঞ্চয়ের অতৃপ্তি ২.আশা আকাঙ্খা পূরণ না হওয়ার ক্ষোভ ৩.পরকালের পাথেয় অর্জন না হওয়ার ব্যাথা।
২৭
এক পলকের পার্থিব অনাসক্তি হাজার বছরের ইবাদত অপেক্ষা মূল্যবান।
২৮
পার্থিব জীবন যেনো একটা গচ্ছিত সম্পত্তি। যখন খুশি মালিকের হাতে সঁপে দিয়ে চলে যাওয়া যায়। এ ভাবনা যারা করেন তাদের মনে কোনো দুঃখ-অশান্তি সৃষ্টি হয় না।
২৯
মন্দ লোকের সংসর্গ ভাল সঙ্গে সদ্ভাব প্রদর্শনে বাধা সৃষ্টি করে।
৩০
তিনিই বুদ্ধিমান যিনি পার্থিব সৌধ ভেঙ্গে তার ওপর গড়ে তোলেন পারলৌকিক ইমারত।
৩১
হৃদয়ে যখন আল্লাহ্-বিরোধিতার লেশমাত্র থাকে না, জানতে হবে তখন মারেফাত অর্জিত হয়েছে।
৩২
যিনি আল্লাহকে চিনেছেন তিনি আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন। আর যিনি দুনিয়াকে চিনেছেন তিনি আল্লাহর সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছেন।
৩৩
মানুষের রিপুগুলোকে খুব শক্ত শেকলে বেঁধে রাখতে হয়।
৩৩
বহিরঙ্গের আনুষ্ঠানিতা দ্বারা জান্নাত লাভ করা যায় না। প্রয়োজন মনের একাগ্রতা ও কঠোর সাধনা।
৩৪
আল্লাহ যাকে ঘৃণিত করে দিয়েছেন, সেই দুনিয়ার প্রতি আসক্ত।
৩৫
যে মানুষ অন্য মানুষদের বশীভূত করতে চায়, সে জ্ঞানী নয়। তার অন্তরে রয়েছে অসৎ উদ্দেশ্য।
৩৬
মনের আয়নায় যখন শুধু সৎ ভাবনা প্রতিফলিত হয়, তখন জানতে হবে সঠিক পথেই রয়েছি। যদি উঠে আসে সৎ চিন্তা, তাহলে ধরে নিতে হবে অসৎ পথেই আছি।
৩৭
অন্যকে কোনো কঠোর আদেশ দানের পূর্বে সে আদেশ নিজের চর্চা করা চাই।
৩৮
যে নামাজ মনকে সংযত করে সে নামাজীই আল্লাহর কাছে ক্ষমার আশা করতে পারে।
৩৯
যে অন্যের দোষ তোমাকে বলে, সে নিশ্চয়ই তোমার দোষও অপরকে বলে।
৪০
যার কথায় না আছে যুক্তি, না আছে বুদ্ধি, তার কথায় কোন উপকার নেই। তার কথা শুনলে সময়ের অপচয়ই শুধু হয়।
