সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (১৯ জানুয়ারি ১৯৩৫ — ১৫ নভেম্বর ২০২০) একজন ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা। অভিনেতা হিসেবে তিনি কিংবদন্তি, তবে আবৃত্তি শিল্পী হিসেবেও তার নাম অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথেই উচ্চারিত হয়। তিনি কবি এবং অনুবাদকও। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার মধ্যে ১৪ টিতে অভিনয় করেছেন।
১#
শক্তির জন্যই তো আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’ প্রকাশিত হলো। অনেক দিন ধরেই ও বলছিল ‘পুলুবাবু একটা কবিতার বই বের করো।’ কিন্তু আমার মনে হতো তখনো সময় আসেনি। এই করতে করতে ৪০ বছর বয়সে শক্তি উঠেপড়ে লাগল। এক প্রকাশক ওর কাছে এসে হাজির আমার কবিতাগুলো বই আকারে বের করবে বলে। শক্তি আমায় বলল, ‘দ্যাখ পুলু, প্রকাশক নিজে এসেছে। আমরা চেষ্টাচরিত্র করে জোগাড় করিনি যখন এবার বই বের হওয়া উচিত।’ শক্তি মাঝেমধ্যে আমার কবিতা পড়ে বলত, “এই কবিতাটা একটু রবীন্দ্রনাথের মতো হয়েছে”। সেই শুনে কবিতা আমি বাতিল করে দিতাম। আসলে তখন আমাদের প্রভাবিত করছে জীবনানন্দ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরা। লেখায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকুক আমরা চাইতাম না। সেটা থাকুক জীবনে।
২#
আমি এমন সহ-অভিনেতার কথা জানি, যাঁর সঙ্গে আমি একটি ছবির শুটিং করছিলাম, প্রয়াত বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির প্রায় পাশেই একটি গৃহে। সেই সুযোগে আমি কবিপত্নী মীনাক্ষীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পর আমার অভিনেতা সহকর্মী আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে, সকলে খুঁজছিল?’ আমি বললাম, ‘আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম।’ ও প্রশ্ন করেছিল, ‘দেখা হলো?’ আমি আরেকবার বললাম, ‘আমি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম।’ ও তখন বলল, ‘বাড়িতে ছিলেন? দেখা হলো?’ আমি বাধ্য হয়ে বললাম, ‘ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলে এখন তো বহুদূর যেতে হবে। ডাক না এলে সেখানে আর যাচ্ছি কী করে?’
৩#
ক্যানসার ডিটেক্টেড হওয়াটা একটা ভয়ানক ধাক্কা। আমার বন্ধুরা শক খাওয়ার মতো তখন বলেছিল, কী রে পুলু বলছিস কী! আমার দাদা প্রচণ্ড আপসেট হয়ে গেলেন। এদের আতঙ্কিত হাবভাব দেখে আমি আরও নার্ভাস হয়ে গেলাম। মৃত্যু তো জানিই—একদিন যেতে হবে। কিন্তু ক্যানসার মানে তো প্রচণ্ড যন্ত্রণা দিয়ে মৃত্যু। মনে মনে ভাবলাম, আমি এর কাছে সাবমিট করব? এই রোগটাকে শিরোধার্য করব? করলে তো হয়েই গেল। তার চেয়ে ফাইট করে দেখি না। আমার আশ্রয় এসব জায়গায় একমাত্র আমিই হতে পারি। ঠিক করলাম, যা থাকে কপালে, আমিই লড়ব।
৪#
আমি মনে করি জাস্ট রিমেইনিং অ্যালাইভটা কোনো জীবন নয়। ইফ ইউ আর নট বিয়িং কালচারালি অ্যালাইভ, ইফ ইউ আর নট বিয়িং ক্রিয়েটিভলি অ্যালাইভ, ইফ ইউ আর নট বিয়িং ক্রিটিক্যালি অ্যালাইভ, তাহলে তুমি বেঁচে নেই। আমার কাছে সেটা জীবন নয়। তাহলে তুমি জাস্ট শারীরিকভাবে বেঁচে আছ। যেটা আমার কাছে মূল্যহীন।
৫#
আমার ভেতরে একটা হীনম্মন্যতা ছিল। আর সেটা ছিল আমার চেহারা নিয়ে। একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার মুখে এ কথা শুনে হয়তো হাসবেন। তবে এর কারণ ছিল। অল্প বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। খুব রুগ্ণ ছিলাম। বাড়ির লোকেরা বলত ছেলেটা কালো, নাক-চোখ-মুখও তেমন নেই। এসব শুনে সংকুচিত হতাম। খেলাধুলো খুব করতাম, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ছিলাম না। তবে অভিনয় দেখে অনেকেই ভালো বলত। অভিনয়ে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। এ জন্যই অভিনয়ে এসেছি।
৬#
শীতকালে সকালবেলায় পুরোনো বই, যেগুলো নতুন সিলেবাসের সঙ্গে মিলত, সেগুলো এপাড়া-ওপাড়ায় ঘুরে জোগাড় করতে হতো। নতুন ক্লাসে ওঠার পর নতুন বইয়ের সিলেবাস পেতাম বটে, বইগুলো সব নতুন কেনা হতো না। সেকেন্ডহ্যান্ড বই, আগের বছর যারা ওই ক্লাস থেকে পাস করে গিয়েছে, খুঁজেপেতে অর্ধেক দামে কিনতে হতো তাদের কাছ থেকে। শুধু খেয়াল রাখতে হতো, বইগুলো ‘ঘিয়ে ভাজা’, অর্থাৎ অতিব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছে কি না। দাদা বলে ডাকি এমন কোনো আগের ক্লাসের ছেলের বাড়িতে হয়তো গিয়েছি বই খুঁজতে, তাদের বাড়িতে মাটির উঠোন, শিরশিরে ঠান্ডা উঠত ওই মাটি থেকে পায়ে। আজও যখন শীতের দিনে খালি পায়ে শুটিং করতে যাই, দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, এখনো যেন সেই ঠান্ডাটা টের পাই।
৭#
অভিনয়ের ভালোবাসার মতো আরেকটা ভালোবাসার জাগরণও হয়েছিল ওই ছেলেবেলাতে। তা হলো দেশকে ভালোবাসা। আমার দাদু হাওড়া বোমা মামলায় জেল খেটেছিলেন, বাবা জেল খেটেছিলেন আইন অমান্য অসহযোগ আন্দোলনের সময়, এসব গল্প স্মৃতির উষালগ্ন থেকেই শুনে আসছি। দাদু ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, তাঁদের ছিল একান্নবর্তী বিরাট পরিবার। পরিবারের মেয়েদের বিয়ের পরেও বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতে হতো না, দাদুর যিনি বড়দিদি, তিনিও বাপের বাড়িতেই থাকতেন, তিনি কবিতা লিখতেন সেই যুগে। তাঁর ছেলে জ্যোতিন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন দাদুর সমবয়সী ও বন্ধু, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যিনি ‘বাঘা যতীন’ বলে বিখ্যাত। বর্গীয় ‘জ’ বদলে তাঁর নামের বানান কীভাবে অন্ত্যস্থ ‘য’ হয়েছিল, সেটা এখন মনে নেই। তবে অসামান্য এই মানুষটির অসাধারণ জীবনের নানা কাহিনি কিংবা ঘটনা, মহত্ত্বের নানান নিদর্শন শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, আজও সেসব আমার স্মৃতিতে অম্লান।
৮#
স্কুলে যাওয়ার পথে রান্নাঘর থেকে দুই ভাই দুটো বিরাট কাঁসার গেলাস নিয়ে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির পেছনের গোয়ালে গিয়ে দাঁড়াতাম। ওই ভোরেই গরু–দোয়া ফেনা ওঠা গরম দুধে ভর্তি হয়ে যেত কাঁসার গেলাস, চোঁ চোঁ করে খেয়ে স্কুলের দিকে এগোতাম। এখন শুনি কাঁচা দুধ খেলে নাকি ইনফেকশন হয়, আমরা তো বছরের পর বছর খেয়েছি, কিচ্ছু হয়নি। এখনকার বাচ্চাদের যেমন আতুপুতু করে মানুষ করার চেষ্টা হয়, আমাদের ছেলেবেলায় তা হতো না। আমরা গাছপালার মতো বড় হয়ে যেতাম।
৯#
নেতারহাট পৌঁছনাের পর পরের দিন ভােরবেলায় শুটিং হবে। প্রচণ্ড শীত, একটা প্রকাণ্ড বড় ঘরে আমরা শুয়ে আছি। ভাের তিনটেয় উঠে মেকআপে বসেছি। মেকআপ হয়ে গেছে। ভােরবেলায় অরণ্যের ঘুম ভাঙছে, বাংলাের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা সকলেই সেই নিবিড় অরণ্যের মধ্যে আস্তে আস্তে আলাের অনুপ্রবেশ দেখতে পাচ্ছিলাম। মানিকদা পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে হঠাৎ একেবারে শিশুর মত বলে উঠলেন, “এ যে একেবারে মাস্টারমশায়ের (আচার্য নন্দলাল বসু) ছবি!” মানিকদার সেই অসহ্য আনন্দ প্রকাশ করার ভঙ্গি আমি কখনও ভুলব না।
১০#
খোলা থাকে খাতা
হাওয়ায় উড়ছে কত সাদা পাতা
হরফেরা ওড়ে পাতারই মতন
হবে তা কখন
পাপড়ির মতো অথবা ব্যথার মতো নীরবতা
অনাগত ফুলে ভরে যাবে পাতা
অথবা কখনও হবে না কুসুম প্রস্ফুটিত
বোঝা হবে না তো কী ছিল আড়ালে
আড়ালেই অবসিত
১১#
বর্ষা বসন্তের স্মৃতি / বেথুয়ার বনরেখা জলঙ্গির হাঁশুলিতে যত গ্রাম / এ সবই তো রেখে দিয়ে যেতে হবে /দুঃখ সেখানেই কিছু বড় নয় / দুঃখ এই দায় ছেড়ে যেতে হবে বলে / স্বেচ্ছাবন্দিত্ব ফেলে রেখে / অনিচ্ছায় অনিশ্চিত আঁধারে
১২#
মানিকদা সারাদিন প্রায় ঘর থেকে বেরােতেনই না, লিখতেন। শুধু | বিকেলে একবার ঘণ্টাখানেক সমুদ্রের ধার দিয়ে বেড়িয়ে আসতেন। একদিন, সন্ধ্যার ঠিক আগে দোতালার বারান্দায় অসিতদার সঙ্গে আমরা গল্প করছি, দূর থেকে দেখতে পেলাম পাজামা-পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘদেহী মানিকদা সমুদ্রতটে হেঁটে যাচ্ছেন। অসিতদা বলে উঠলেন- “দেখুন, দেখুন মানিকবাবু যাচ্ছেন। আচ্ছা, ওই লােকটা বিশ্ববিখ্যাত হবে না তাে কি আমরা হব! আমিও চিত্রনাট্য লিখতে এখানে এসেছি, উনিও চিত্রনাট্য লিখতে এখানে এসেছেন। অথচ দেখুন, আমি সারাদিন আড্ডা মারছি— সমুদ্রে স্নান করছি, সন্ধেবেলায় রাম খাচ্ছি, লেখা আর এগােচ্ছে না। আর উনি সারাদিন সমুদ্রটমুদ্র অগ্রাহ্য করে ঘরের মধ্যে বসে বসে লিখে যাচ্ছেন, একবার শুধু সন্ধের আগে একটু সমুদ্রের ধারে হাঁটতে যাচ্ছেন। এই-ই তাে সাধনা।
১৩#
এমন অবিস্মরণীয় শিল্পী, এরকম দরদী অভিভাবকের মত বন্ধুর অনুপস্থিতিতে কেবলই যখন মনে হয় জীবনের অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেল, অনেকটাই অর্থশূন্য হয়ে গেল, তখন এক বিদেশিনী বন্ধুর একটি সান্ত্বনাবাক্য আমার মনে পড়ে যায়। তিনি মানিকদার ভীষণ ভক্ত ও পরিচিত। মানিকদার মৃত্যুর পরের দিন যখন তার দেহ সারাদিন দর্শনার্থীদের জন্যে নন্দনে শায়িত ছিল, সেইদিন কোনও সময়ে আমাকে নিতান্ত সন্তপ্ত ও বিপর্যস্ত দেখে বিদেশিনী বন্ধুটি আমাকে বলেছিলেন, ‘Don’t cry Soumitra, Manikda has given you a heritage’.
১৪#
তবু কান পেতে রাখা ভালো
যদি কিছু মাত্র শোনা যায়—
কোনো স্পন্দন, হৃদয় বলে যে ভূকম্পন যন্ত্র আছে
যদি ধরা দেয় সেইখানে—
কোথাও মানুষের প্রতি আর এক মানুষ,
শুধু সমব্যথী বলে যদি
মমতায় আর্দ্র হয়,
কান পেতে রাখা ভালো,
মানুষের মন যদি খুব নিচু স্বরে, সেই কথা বলে।
চারিদিকে খুব সবল চিৎকার চলেছে,
স্খলিত দুএকটা ক্ষুর তারই মধ্যে
যদি নিয়ে আসে বসন্তের আসন্ন বাতাস,
তাই কান পেতে রাখা ভালো,
হৃদয় নামেতে যে ভূকম্পন যন্ত্র আছে,
যদি শিহরিত হয়!

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.