শ্রীকান্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি জীবনচরিত মূলক উপন্যাস। তিনি এই উপন্যাসটি মোট চার খণ্ডে সমাপ্ত করেন। চারটি খণ্ড একসাথে লেখেন নি। যথাক্রমে ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭ এবং ১৯৩৩ সালে চারটি খণ্ড লেখা শেষ করেন।
প্রিয় পাঠক এই ব্লগে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের বিখ্যাত কিছু লাইন ও উক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
১#
বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া ফেলে!
২#
ছেলেবেলায় একবার যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কি কখনো ভুলা যায়?
৩#
মিথ্যা ভুলিয়া তো কোন বস্তুর অস্তিত্ব এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে—চোখে পড়ে না। মিথ্যা শুধু– মানুষের বুঝিবার ও বুঝাইবার ফল সোনাকে পিতল বলিয়া বুঝানো মিথ্যা, বুঝাও মিথ্যা।
৪#
হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলিয়া গত কথা লইয়া পরিতাপ করিয়া লাভ নাই।
৫#
লাভ-ক্ষতি কি সংসারের সব? মায়া-মমতা-ভালবাসাটা কি কিছু নয়?
৬#
বুদ্ধি দিয়ে যারা একেবারেই মানে না, তাহারাও ভয়ের জায়গায় আসিয়া পড়িলে ভয়ে মূর্ছা যায়।
৭#
জীবনে এমন সব শুভ মুহূর্ত অনেক বার আসে না। একবার যদি আসে সে সমস্ত চেতনার উপর এমন গভীর একটা ছাপ মারিয়া দিয়া যায় যে, সেই ছাঁচেই সমস্ত পরবর্তী জীবন গড়ে উঠেছে থাকে।
৮#
পর দুঃখে ব্যথা পাইয়া চোখের জল ফেলা সহজ নহে, তাহা অস্বীকার করি না কিন্তু তাই বলিয়া সেই দুঃখের মধ্যে নিজের দুই হাত বাড়াইয়া আপনাকে জড়িত করিতে যাওয়া সে ঢের বেশি কঠিন কাজ।
৯#
আমার বুকের কষ্টিপাথরে—-পাকা সোনার কষ ধরানো আছে সেখানে পিতলের দোকান খুলিলে—- খরিদ্দার জুটিবে না।
১০#
এই মেয়ে মানুষের জাতটা একবার যদি ভালোবেসেছে তো মরেছে!
১১#
পরকে কথাই ভুলিয়ে বশ করা যায় কিন্তু জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত নিজেই যার বশ হয়ে আছি তাকেও কি— কথায় ভুলানো যায়?
১২#
না জানিয়া নারীর কলঙ্কে অবিশ্বাস করিয়া সংসারে বরঞ্চ ঠকাও ভালো, কিন্তু বিশ্বাস করিয়া পাপের ভাগী হওয়ার লাভ নেই।
১৩#
তাহাকে ধরিয়া রাখিলে হয়ত রাখিতে পারিতাম , কিন্তু সে চেষ্টা করিলাম না । সেও আর ফিরিয়া আসিল না — আমারও যতক্ষণ না ঘুম আসিল শুধু এই কথাই ভাবিতে লাগিলাম , জোর করিয়া রাখিয়া লাভ হইত কি ? আমার পক্ষ হইতে ত কোনদিন কোন জোরই ছিল না , সমস্ত জোরই আসিয়াছিল তাহার দিক দিয়া । আজ সে – ই যদি বাঁধন খুলিয়া আমাকে মুক্তি দিয়া আপনাকে মুক্ত করিতে চায় ত আমি ঠেকাইব কোন্ পথে ?
১৪#
ইহাকে আমি কোনদিন ভালবাসি নাই। তবু ইহাকে আমার ভালবাসিতেই হইবে; কোথাও কোনদিকে বাহির হইবার পথ নাই । পৃথিবীতে এত বড় বিড়ম্বনা কি কখনো কাহারো ভাগ্যে ঘটিয়াছে!
১৫#
একজন আর একজনের মন বোঝে– সহানুভূতি আর ভালবাসা দিয়া-বয়স আর বুদ্ধি দিয়া নয়। সংসারে যে যত ভালোবাসিয়াছে পরের হৃদয়ের ভাষা তাহার কাছে ততো— ব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে।
১৬#
ভ্রমণ করা এক, তাহা প্রকাশ করা আর এক। যাহার পা দু’টা আছে সেই ভ্রমণ করিতে পারে কিন্তু হাত দু’টা থাকলেই তো আর লেখা যায় না সে যে ভারি শক্ত!
১৭#
মানুষের স্বভাবই তো এই। একটু খানি দোষ পাইলেই পূর্ব-মুহূর্তের সমস্তই নিঃশেষে ভুলিয়া যাইতে তাহার কতক্ষণ লাগে।
১৮#
কি করিয়া যে ভোগী একদিন ত্যাগী হইয়া বাহির হইয়া যায়, নির্মম নিষ্ঠুর এক মূহুর্তে করুণায় গলিয়া নিজেকে নিঃশেষ করিয়া ফেলে, এ রহস্যের কতটুকু সন্ধান পাই! কোন নিভৃত কন্দরে যে মানবাত্মার গোপন সাধনা অকস্মাৎ একদিন সিদ্ধিতে ফুটিয়া উঠে তাহার কি সংবাদ রাখি?
১৯#
স্নেহের গভীরতা কিছুতেই কালের স্বল্পতা দিয়া মাপা যায় না ; এবং এই বস্তুটা কাব্যের জন্য কবিরা কেবল শূন্য কল্পনাই করেন নাই — সংসারে ইহা যথার্থই ঘটে । তাই , একের যাওয়ার প্রয়োজনও যতখানি সত্য , অপরের আকুল কণ্ঠের একান্ত নিষেধটাও ঠিক ততখানি সত্য কি না , এ লইয়া আমার মনের মধ্যে বিন্দু – পরিমাণও সংশয়ের উদয় হইল না।
২০#
আশ্চর্য দেশ এই বাঙ্গলা দেশটা। এর পথেঘাটে মা-বোন , সাধ্য কি এঁদের এড়িয়ে যাই।
২১#
ওই যে কাল সকালে ঐ ন’বছরের মেয়েটাকে কোন্ অপরিচিত সংসারে টেনে নিয়ে যাবে, আর কখনও হয়ত আসতে পর্যন্ত দেবে না। এদের নিয়মই এই। বাপ ছ’গণ্ডা টাকায় মেয়েটাকে আজ বিক্রি করে দেবে। ‘ একবার পাঠিয়ে দাও’ এ কথা মুখে আনবারও জো থাকবে না। আহা! মেয়েটা সেখানে কতই কাঁদবে — বিয়ের সে কি জানে বল ?
২২#
সংসারে করিব বলায় এবং সত্যকার করায় কত বড়ই না ব্যবধান!
২৩#
কর্মহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবনের দিবারম্ভ হয় শ্রান্তিতে, অবসান হয় অবসন্ন গ্লানিতে। নিজের আয়ুষ্কালটাকে নিজের হাত দিয়া প্রতিনিয়ত হত্যা করিয়া চলা ব্যতীত সংসারে আর যেন আমার কিছু করিবার নাই।
২৪#
যার লোভ নেই, যে চায় না, তাকে সাহায্য করতে যাওয়ার মত বিড়ম্বনা আর নেই।
২৫#
মনে হয় , কত লোকের গায়ের স্পর্শ এবং কত না অচেনা লোকের তপ্ত শ্বাসের আমি যেন ভাগ পাই। হয়ত, আমার সেই ছেলেবেলার বন্ধু ইন্দ্রনাথ আজিও বাঁচিয়া আছে, এই উষ্ণ বায়ু হয়ত তাহাকে এইমাত্র ছুঁইয়া আসিল। হয়ত, সে আমারই মত তাহার অনেকদিনের সুখ-দুঃখের শিশু সঙ্গীটিকে স্মরণ করিতেছে।
২৬#
রাজলক্ষ্মী একমুহুর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, যাই হোক, ভালবাসাটাও ত একরকমের বাঁধন, বোধ হয় এও তোমার সয় না— গায়ে লাগে। এ অভিযোগের জবাব নাই, এ অভিযোগ শাশ্বত ও সনাতন। আদিম মানব – মানবী হইতে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এ কলহের মীমাংসক কেহ নাই— এ বিবাদ যেদিন মিটিবে , সংসারের সমস্ত রস , সমস্ত মাধুর্য সেদিন তিক্ত বিষ হইয়া উঠিবে । তাই উত্তর দিবার চেষ্টামাত্র না করিয়া নীরব হইয়া রহিলাম ।
২৭#
মানুষকে পশু করিয়া না লইতে পারিলে পশুর কাজ আদায় করা যায় না।
২৮#
এই জীবনব্যাপী ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখের অবস্থাগুলা যেন আতসবাজির বিচিত্র সাজ-সরঞ্জামের মত শুধু একটা কোন বিশেষ দিনে পুড়িয়া ছাই হইবার জন্যই এত যত্নে এত কৌশলে গড়িয়া উঠিতেছে।
২৯#
মড়ার কি জাত থাকে রে?
৩০#
সেই বয়সেই আমি কেমন করিয়া যেন জানিতে পারিয়াছিলাম, ‘বড়’ ও ‘ছোট’র বন্ধুত্ব সচরাচর এমনিই দাঁড়ায়। বোধ করি ভাগ্যবশে পরবর্তী জীবনে অনেক ‘বড়’ বন্ধুর সংস্পর্শে আসিব বলিয়াই ভগবান দয়া করিয়া এই সহজ জ্ঞানটা আমাকে দিয়াছিলেন যে, কখনও কোন কারণেই যেন অবস্থাকে ছাড়াইয়া বন্ধুত্বের মূল্য ধার্য করিতে না যাই। গেলেই যে দেখিতে দেখিতে ‘বন্ধু’ প্রভু হইয়া দাঁড়ান এবং সাধের বন্ধুত্বপাশ দাসত্বের বেড়ি হইয়া ‘ছোট’র পায়ে বাজে, এই দিব্যজ্ঞানটি এত সহজে এমন সত্য করিয়াই শিখিয়াছিলাম বলিয়া লাঞ্ছনার হাত হইতে চিরদিনের মত নিষ্কৃতি পাইয়া বাঁচিয়াছি।
৩১#
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্তটাই পরিপূর্ণ সত্য। মিথ্যার অস্তিত্ব যদি কোথাও থাকে, তবে সে মনুষ্যের মন ছাড়া আর কোথাও না।
৩২#
মানুষের অন্তর জিনিসটিকে চিনিয়া লইয়া, তাহার বিচারের ভার অন্তর্যামীর উপর না দিয়া মানুষ যখন নিজেই গ্রহণ করিয়া বলে, আমি এমন, আমি তেমন, এ কাজ আমার দ্বারা কদাচ ঘটিত না, সে কাজ আমি মরিয়া গেলেও করিতাম না—আমি শুনিয়া আর লজ্জায় বাঁচি না। আমার শুধু নিজের মনটাই নয়; পরের সম্বন্ধেও দেখি, তাহার অহঙ্কারের অন্ত নাই। একবার সমালোচকের লেখাগুলো পড়িয়া দেখ—হাসিয়া আর বাঁচিবে না। কবিকে ছাপাইয়া তাহার কাব্যের মানুষটিকে চিনিয়া লয়। জোর করিয়া বলে, এ চরিত্র কোন মতেই ওরূপ হইতে পারে না, সে চরিত্র কখনও সেরূপ করিতে পারে না—এমনি কত কথা। লোকে বাহবা দিয়া বলে, বাঃ রে বাঃ! এই ত ক্রিটিসিজম্। একেই ত বলে চরিত্র-সমালোচনা! সত্যই ত! অমুক সমালোচক বর্তমান থাকিতে ছাই-পাঁশ যা-তা লিখলেই কি চলিবে? এই দেখ বইখানার যত ভুল-ভ্রান্তি সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া ধরিয়া দিয়াছে! তা দিক। ত্রুটি আর কিসে না থাকে!
৩৩#
কাল যে ছিল, আজ সে নাই। কাল প্রভাতে কে ভাবিয়াছিল, আজ এমনি করিয়া আমাদের নিশাবসান হইবে! কে জানিত, একজনের শেষমুহুর্ত এত কাছেই ঘনাইয়া উঠিয়াছিল!
৩৪#
মনে হইল, এই যেখানে পা রাখিয়া বসিয়াছি, সেইখানে পা দিয়া কত লোক কতবার আসিয়াছে, গিয়াছে। এই ঘাটেই তাহারা স্নান করিত, গা ধুইত, কাপড় কাচিত, জল তুলিত। এখন তাহারা কোথাকার কোন্ জলাশয়ে এই-সমস্ত নিত্যকর্ম সমাধা করে? এই গ্রাম যখন জীবিত ছিল, তখন নিশ্চয়ই তাহারা এমনি সময়ে এখানে আসিয়া বসিত; কত গান, কত গল্প করিয়া সারাদিনের শ্রান্তি দূর করিত। তারপরে অকস্মাৎ একদিন যখন মহাকাল মহামারীরূপে দেখা দিয়া সমস্ত গ্রাম ছিঁড়িয়া লইয়া গেলেন, তখন কত মুমূর্ষু হয়ত তৃষ্ণায় ছুটিয়া আসিয়া এই ঘাটের উপরেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া তাঁহার সঙ্গে গিয়াছে। হয়ত তাহাদের তৃষ্ণার্ত আত্মা আজিও এইখানে ঘুরিয়া বেড়ায়। যাহা চোখে দেখি না তাহাই যে নাই এমন কথাই বা কে জোর করিয়া বলিবে?
৩৫#
আমি টের পাইয়াছি মানুষ শেষ পর্যন্ত কিছুতেই নিজের সমস্ত পরিচয় পায় না। সে যা নয়, তাই বলিয়া নিজেকে জানিয়া রাখে এবং বাহিরে প্রচার করিয়া শুধু বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে; এবং যে দণ্ড ইহাতে দিতে হয়, তা নিতান্ত লঘুও নয়।

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.