শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ – ১৭ আগস্ট ২০০৬) ছিলেন বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধানতম কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা পঞ্চাশের দশকে তিনি আধুনিক কবি হিসেবে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হন এবং অল্প সময়ের ভেতরেই দুই বাংলায় কবি হিসেবে পরিচিতি পান। আধুনিক কবিতার অনন্য পৃষ্ঠপোষক বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘রূপালি স্নান’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে শামসুর রাহমান সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীতে উভয় বাংলাতেই তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি নাগরিক কবি, তবে নিসর্গ তার কবিতায় খুব কম ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তার দুটি কবিতা খুবই জনপ্রিয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) ছদ্মনামে কলকাতার বিখ্যাত দেশ ও অন্যান্য পত্রিকায় কবিতা লিখতেন।
বিংশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। কেবল বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদ এবং পশ্চিমবঙ্গের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিংশ শতকের শেষার্ধে তুলনীয় কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বলে ধারণা করা হয়। আধুনিক কবিতার সাথে পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৯-এ, এবং তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৪৯ মুদ্রিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়।
কবিতা
যখন তোমার সঙ্গে আমার হলো দেখালেকের ধারে সঙ্গোপনে,বিশ্বে তখন মন্দা ভীষণ, রাজায় রাজায়চলছে লড়াই উলুর বনে।
যখন তোমার পায়রা-হাতে হাতটা রেখেডুবে থাকি স্বর্গসুখে,তখন কোনো গোলটেবিলে দাবার ছকেশ্বেত পায়রাটা মরছে ধুঁকে।
আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতোমিলি রাতের গভীর যামে,
তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা,পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে!
প্রেমের পদাবলী
১
তোমার চোখের মতো আমি দেখিনি কখনো,
তোমার ঠোঁটের মতো ঠোঁটে ওষ্ঠ করিনি স্থাপনকোনোদিন, তোমার বুকের পাখি একদা ধ্বনিত এজীবনে।
তোমার চুলের মতো চুল কোথাও কি এরকমছায়া দেয় ক্লান্তির প্রহরে? মুছে ফেলে হিংস্রদুঃস্বপ্নগুলোকে?
এই যে কবিতা লিখে সত্যের অধিক সত্য রটিয়ে দিলামসারা বাংলাদেশে, তার মর্মকথা তুমিই জানো না।
২
বালিকা-বয়সে তুমি কী রকম ছিলে? বাগানের চারাগাছজড়িয়ে কোমল বুকে উঠতে কি দুলে ফুল হওয়ারআশায়?
অনেক বছর আগে-যখন দোয়েল ছিল হৃদয়ে আমার,
যখন আমার চোখ যৌবনের প্রথম স্বপ্নের আচ্ছন্নতা-
তুমি যে বালিকা বিদ্যালয়ে যেতে হাসিখুশি নীল-শাদাফ্রকপরে,
বেণী দুলিয়ে সকালবেলা, আমি ছড়ি হাতেগোধূলিতে
তার কাছ ঘেঁষে হাঁটি একা মাঝে-মাঝে বৈকালিক ভ্রমণেরঅছিলায়, যদি পেয়ে যাই তোমার বালিকা-বয়সের ঘ্রাণ।
৩
একটি সোনালি দিন শুধু দিয়েছিলে উপহার,
কেবল একটি দিন কেটেছিল সান্নিধ্যে তোমার
প্রতিটি মুহূর্ত নেচেছিল, মনে পড়ে, শ্যামা পাখির মতননিরিবিলি, একটি সোনালি দিন পথে ঘুরেলিখেছি কবিতা, প্রিয়তমা, তোমারই উদ্দেশে। যদিএকটি দিনের সঙ্গ কবিতার ইতিহাসে অমরতা পায়,
তা’হলে বলো তো কেন এরকম কার্পণ্য তোমার?
৪
ক’দিন জ্বরের ঘোরে কেটেছে আমার;
তুমি এলেঅপরাহ্নে এবং উপেক্ষা করে পরিবেশ আমার উপর ঝুঁকেঠোঁটে ঠোঁটে ছোঁয়ালে প্রগাঢ়,
স্তনভারলহমায় দ্রুত করে হৃৎস্পন্দন আমার।
কী সহজেভুলে গেলে সমাজের বিরূপতা, আমাকে সারিয়েতুললে অলৌকিক পথ্যে,
তোমার কবোষ্ণ কোলে মাথারেখে শুয়ে থাকি আর কখনো তোমাকে, কখনো বাকবিতাকে দেখে নিই-
ক’দিন জ্বরের পরে এই তো তোমার সঙ্গে স্বপ্নে দেখাহলো।
৫
এখন ঘুমিয়ে আছো তুমি বৈবাহিক বিছানায়,
মৈথুনের ক্লান্তি কুয়াশার মতো লেগে আছে সারাশরীরে তোমার,
প্রেম জাগে সপ্তর্ষিমন্ডলে আরআমি দূরে বাংলা কবিতার মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছিএক ঠায়, ঘুম নেই।
তোমার নিদ্রার রূপ ভেবেচতুর্দশপদী লিখি, গোপন ঈর্ষায় জ্ব’লে নিইপ্রতিশোধ নিজেরাই উপর।
শোনো, একদিন আমিওঘুমিয়ে পড়ব, জাগব না আর, তুমি জেগে থেকো।
৬
ঢাকার সুন্দরীদের খ্যাতি প্রজাপতি হয়ে ওড়েবহু ঠোঁটে, লাস্যময়ী রমণীরা সৌন্দর্যের উগ্র ঢেউতুলে কূটনৈতিক পার্টিতে কিংবা ফ্যাশন শো-এরঝলমলে হলঘরে ঘোরে প্রায়শই। তোমাকে যায় না দেখাসেখানে কখনো,
তুমি আছো খুব নিরালায়এই শহরের এক কোণে আপন সৌন্দর্য নিয়ে। তোমারমতনসুন্দর দেখিনি কাউকেই। অবিশ্বাস্য মনে হ’লেআমার প্রেমের পদাবলী ভাল ক’রে প’ড়ে দেখো।
যদি তুমি ফিরে না আসো
তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না।
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলেতুমিআছো এই সংসারে, হাঁটছো বারান্দায়, মুখ দেখছোআয়নায়, আঙুলে জড়াচ্ছো চুল, দেখছোতোমারসিথিঁ দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তহীন উদ্যানের পথ,
দেখছোতোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর,আমাকে মন থেকে মুছে ফেলেতুমি অস্তিত্বের ভূভাগে ফোটাচ্ছো ফুল,আমি ভাবতেই পারি না।
যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমিআমাকে ভুলে যেতে পারো,যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়াকোনো উপন্যাস,
তখন ভয়কালো কামিজ পরে হাজির হয় আমার সামনে,পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে,
তখনএকটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকেআর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতেঅবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়,
যেমনভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে।বিদায় বেলার সাঁঝটাঝ আমি মানি না,
আমি চাই ফিরে এসো তুমি স্মৃতির প্রান্তরপেরিয়েশাড়ির ঢেউ তুলে, সব অশ্লীল চিৎকার, সব বর্বরবচসা স্তব্ধ করে দিয়ে ফিরে এসো তুমি,ফিরে এসো স্বপ্নের মতো চিলেকোঠায়,মিশে যাও আমার হৃৎস্পন্দনে।
কোথায় আমাদের সেই অনুচ্চারিত অঙ্গীকার?
কোথায় সেই অঙ্গীকারযা রচিত হয়েছিলো চোখের বিদ্যুতের বর্ণমালায়?
আমরা কি সেই অঙ্গীকারে দিইনি ত্রঁটেআমাদের চুম্বনের সীলমোহর?
আমি ভাবতেই পারি না সেই পবিত্র দলিল ধুলোয় লুটিয়েদুপায় মাড়িয়ে, পেছনে একটা চোরাবালি রেখেতুমি চলে যাবে স্তব্ধতার গলায় দীর্ঘশ্বাস পুরে।
আমার চোখ মধ্যদিনের পাখির মতো ডেকে বলছে-তুমি এসো,আমার হাত কাতর ভায়োলিন হয়ে ডাকছে- তুমি এসো,আমার ঠোঁট তৃষ্ণার্ত তটরেখার মতো ডাকছে-তুমি এসো।
বেস্টসেলারের স্টোর
যদি তুমি ফিরে না আসোগীতবিতানের শব্দমালা মরুচারী পাখির মতোকর্কশ পাখসাটে মিলিয়ে যাবে শূন্যে,
আর্ট গ্যালারির প্রতিটি চিত্রের জায়গায় জুড়ে থাকবেহা-হা শূন্যতা,ভাস্করের প্রতিটি মূর্তি পুনরায় হয়ে যাবে কেবলি পাথর,সবগুলো সেতার, সরোদ, গিটার, বেহালাশুধু স্তূপ স্তূপ কাষ্ঠখণ্ড হয়ে পড়ে থাকবে এক কোণে।
যদি তুমি ফিরে না আসো,গরুর ওলান থেকে উধাও হবে দুধের ধারা,
প্রত্যেকটি রাজহাঁসের সবগুলো পালক ঝরে যাবে,পদ্মায় একটি মেয়ে-ইলিশও আর ছাড়বে না ডিম।
যদি তুমি ফিরে না আসো,ত্রাণ তহবিলে একটি কানাকড়িও জমা হবে না,বেবি ফুডের প্রত্যেকটি কৌটোয় গুঁড়ো দুধ নয়কিলবিল করবে শুধু পোকামাকড়।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
দেশের প্রত্যেক চিত্রকর বর্ণের অলৌকিক ব্যাকরণভুল মেরে বসে থাকবেন,
প্রত্যেক কবির খাতায়কবিতার পংক্তির বদলে পড়ে থাকবে রাশি রাশি মরা মাছি।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
এ দেশের প্রতিটি বালিকাথুত্থুড়ে বুড়ি হয়ে যাবে এক পলকে,
এ দেশের প্রত্যেকটি যুবক মৃত্যুর মাত্রায়ঘুমের বড়ি কিংবা গলায় দেবে দড়ি।
যদি তুমি ফিরে না আসো,ভোরের শীতার্ত হাওয়ায় কান্না-পাওয়া চোখে নজরুল ইসলামহন্তদন্ত হয়ে ফেরি করবেন হরবোলা সংবাদপত্র।
যদি তুমি ফিরে না আসো,সুজলা বাংলাদেশের প্রতিটি জলাশয় যাবে শুকিয়ে,সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশেরপ্রতিটি শস্যক্ষেত্র পরিণত হবে মরুভূমির বালিয়াড়িতে,বাংলাদেশের প্রতিটি গাছ হয়ে যাবে পাথরের গাছপ্রতিটি পাখি মাটির পাখি।
উত্তর
তুমি হে সুন্দরীতমা
নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো‘এই আকাশ আমার’কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবেনা।
সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো,
‘ফুল তুই আমার’তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।
জ্যোত্স্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,তোমার বলার অধিকার আছে,
‘এ জ্যোত্স্না আমার’কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর।
মানুষ আমি, আমার চোখে চোখ রেখেযদি বলো,
‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকবো নির্বাক ?
তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’।
কেন এ রকম হয়?
কেন এ রকম হয়? হবে? কেন তুমি অভিমানে
স্তব্ধ হয়ে যাবে? কেন এতক্ষণ করবে না ফোন?
আমার অসুবিধে নেই, টেলিফোনও কিছু বিগড়ে আছে।
এই যে মুহূর্তগুলি, ঘণ্টাগুলি আমাকে চিবিয়ে
খাচ্ছে হিংস্র বিড়ালের মতো, তুমি কি বোঝো না? হায়,
এ বয়সে আমি আর কত কষ্ট পাব? কী আমার
অপরাধ, বুঝতে অক্ষম। গাছ হয়ে জন্মানোই
ছিল ঢের ভালো, বিষাদের লেশমাত্র থাকত না।
তোমাকে উপেক্ষা করি, এই মতো ভাবনায় তুমি
সম্প্রতি কাতর নাকি! অথচ আমি যে সারাক্ষণ
জপছি তোমাকে, এমন কী স্বপ্নের ঘোরেও করি
উচ্চারণ ভালোবাসা তোমার উদ্দেশে। আলিঙ্গনে
বাঁধি তোমাকেই মাঠে, নদীতীরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে।
কীভাবে তোমার রোষে, প্রিয়তমা, অস্তমিত হবে?
