দেশে বিদেশে’ মুজতবা আলীর প্রথম বই এবং অনেক সমালোচকের মতে সর্বশ্রেষ্ঠ। তার রসনা ভরা শব্দে বিন্যস্ত বর্ণিল অভিজ্ঞতার সাথে মানুষ প্রথমবারের মতো পরিচিত হয়। এটা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক কোনো ভ্রমণকাহিনী। কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত একটি ভ্রমণকাহিনি, যা ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সালের আফগানিস্তান ভ্রমণের উপর রচিত। এটি ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। একটি ভ্রমণলিপি হওয়া সত্ত্বেও এটি আফগানিস্তানের লিখিত ইতিহাসের একটি অনবদ্য দলিল।
১
হেঁটে বেড়ানো কাবুলীরা পছন্দ করে না। প্রথম বিদেশী ডাক্তার যখন এক কাবুলী রোগীকে হজমের জন্য বেড়াবার উপদেশ দিয়েছিলেন তখন কাবুলী নাকি প্রশ্ন করেছিল যে, পায়ের পেশীকে হায়রান করে পেটের অন্ন হজম হবে কি করে?
২
বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটবুক কি-বলে না-বলে সেটা অবান্তর, জীবনে কাজে লাগে বাজারের গাইড-বুক।
৩
বোরকা পরে, ঐ যা। তা না হলে পাঠান মেয়েও স্বাধীন।
৪
কাবুলী বললেন, ‘দুনিয়ার সব পরীক্ষা পাস করার চেয়ে বড় পরীক্ষা খাইবার-পাস পাস করা। অলহামদুলিল্লা (খুদাকে ধন্যবাদ)। আমি বললুম, ‘আমেন।
৫
সর্দারজী হেসে বললেন, ‘কিছু ভয় নেই, পেশাওয়াৱ স্টেশনে এক গাড়ি বাঙালী নামে না, আপনি দু’মিনিট সবুর করলেই তিনি আপনাকে ঠিক খুঁজে নেবেন।’
আমি সাহস পেয়ে বললুম, ‘তা তাে বটেই তবে কিনা শৰ্ট পরে এসেছি —‘
সর্দারজী এবার অট্টহাস্য করে বললেন, ‘শর্টে যে এক ফুট জায়গা ঢাকা পড়ে তাই দিয়ে মানুষকে চেনে নাকি?
৬
সরু চালের ভাত আর ইলিশ মাছ ভাজার চেয়ে উপাদেয় খাদ্য আর কিছুই হতে পারে না। মূর্খ বলে কিনা বিরয়ানি-কুর্মা তার চেয়ে অনেক ভালো। … যে নরাধম ইলিশ মাছের অপমান করে তার মুখদর্শন করা মহাপাপ…।
৭
বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ী ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ী, আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়!
৮
দেশভ্রমণকারী গুণীদের মুখে শোনা যে, যাদের গায়ের জোর যেমন বেশী, তাদের স্বভাবও হয় তেমনি শান্ত।
৯
বাঙালি আর কিছু পারুক না পারুক,বাজে তর্কে খুব মজবুত ।
১০
বাঙলা শব্দের অন্ত্যদেশে অনুস্বার যোগ করিলে সংস্কৃত হয়; ইংরিজী শব্দের প্রাগদেশে জোর দিয়া কথা বলিলে সায়েবী ইংরিজী হয় অর্থাৎ পয়লা সিলেবলে অ্যাকসেন্ট দেওয়া খারাপ রান্নায় লঙ্কা ঠেসে দেওয়ার মত – সব পাপ ঢাকা পড়ে যায়।
১১
উঠোন সমুদ্র পেরলেই আধেক মুশকিল আসান।” (বাংলা প্রবাদ)
১২
যাত্রার দিনই অর্ধেক ভ্রমণ।” (আরবি প্রবাদ)
১৩
বলা তো যায় না, ফিরিঙ্গীর বাচ্চা- কখন রঙ বদলায়।
১৪
এই তালতলারই আমার এক দার্শনিক বন্ধু একদিন বলেছিলেন যে, এমেটিন ইনজেকশন নিলে মানুষ নাকি হঠাৎ অত্যন্ত স্যাঁৎসেঁতে হয়ে যায়, ইংরিজীতে যাকে বলে ‘মডলিন’- তখন নাকি পাশের বাড়ির বিড়াল মারা গেলে মানুষ বালিশে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বিদেশে যাওয়া আর এমেটিন ইনজেকশন নেওয়া প্রায় একই জিনিস।
১৫
বাঙালী আপন দেশে ব’সে, এভারেস্টের গায়ে ফিতে না লাগিয়ে, চূড়োয় চড়তে গিয়ে খামখা জান না দিয়ে ইংরেজকে বাৎলে দেয়নি, ঐ দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়?
১৬
কবির তুলনায় দার্শনিক ঢের বেশী হুঁশিয়ার হয়। তাই বোধ হয় কবির হাতে রাষ্ট্রের কি দুরবস্থা হতে পারে, তারই কল্পনা করে প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে ভালোমন্দ সব কবিকেই অবিচারে নির্বাসন দিয়েছিলেন।
১৭
ডিমোক্রেসি ডিমোক্রেসি জিগির তুলে বড্ড বেশী চেঁচামেচি করাতে দক্ষিণভারতের এক সাধক বলেছিলেন ‘তাহলে সবাই ঘুমিয়ে পড়। ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষে ভেদ থাকে না, সবাই সমান।’
১৮
ভাবপ্রবণ বাঙালী একবার অনুভূতিগত বিষয়বস্তুর সন্ধান পেলে মূল বক্তব্য বেবাক ভুলে যায়।
১৯
ছয় ঋতুতে ছয় রকম করে প্রিয়ার বিরহযন্ত্রণা ভোগ না করা পর্যন্ত মানুষ নাকি পরিপূর্ণ বিচ্ছেদবেদনার স্বরূপ চিনতে পারে না…।
২০
কোনো তর্ক নেই, যুক্তি নেই, ন্যায় অন্যায় নেই, মেয়েদের কর্ম হচ্ছে পুরুষের আকাট মূর্খতার জন্য চোখের জল ফেলে খেসারতি দেওয়া। কিন্তু আশ্চর্য, এ-বেদনাটা প্রকাশও করে আসছে পুরুষই কবিরূপে। শুনেছি পাঁচ হাজার বৎসরের পুরোনো ববিলনের প্রস্তরগাত্রে কবিতা পাওয়া গিয়েছে কবি মা-জননীদের চোখের জলের উল্লেখ করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
২১
ইহলোকে বক্ষলগ্ন থাকবে রাইফেল, পরলোকে হুরী, এই পুরুষ-প্রকৃতির উপর আফগান-দর্শন সংস্থাপিত।
২২
আমাদের চাষার গামছা আর কাবুলী চাষার পাগড়ি দুই-ই একবস্তু। হেন কর্ম নেই যা গামছা আর পাগড়ি দিয়ে করা যায় না-ইস্তেক মাছ ধরা পর্যন্ত।
২৩
কাবুল উপত্যকার চাষারা দেখলুম বাঙালী চাখার মতই নিরীহ – মারামারির চেয়ে গালাগালিই বেশী পছন্দ করে তার কারণ বোধ হয় এই যে, কাবুল উপত্যকা বাংলা দেশের জমির চেয়েও উর্বরা।
২৪
পণ্ডিতে মুর্খে মিলে আফগানিস্থান সম্বন্ধে যে সব তথ্য আবিষ্কার করেছেন তার মোটামুটি তত্ত্ব এই – আর্যজাতি আফগানিস্থান, খাইবারপাস হয়ে ভারতবর্ষে এসেছিল – পামির, দার্দিস্থান বা পৈশাচভূমি কাশ্মীর হয়ে নয়। বোগাজ-কোই বর্ণিত মিতানি রাজ্য ধ্বংসের পরে যদি এসে থাকে তবে প্রচলিত আফগান কিংবদন্তী যে আফগানরা ইহুদীদের অন্যতম পথভ্রষ্ট উপজাতি সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। অর্থাৎ কিংবদন্তী দেশ ঠিক রেখেছে কিন্তু পাত্র নিয়ে গোলমাল করে ফেলেছে।
২৫
এক বৃদ্ধা দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘পালা-পরবে নেমন্তন্ন পেলে অরক্ষণীয়া মেয়ে থাকলে মায়ের মহা বিপদ উপস্থিত হয়। রেখে গেলে গলার আল, নিয়ে গেলে লোকের গাল।’ তারপর বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘বাড়িতে যদি মেয়েকে রেখে যাও তাহলে সমস্তক্ষণ দুর্ভাবনা, ভালো করলুম না মন্দ করলুম; সঙ্গে যদি নিয়ে যাও তবে সক্কলের কাছ থেকে একই গালাগাল, এতদিন ধরে বিয়ে দাওনি কেন?’
২৬
মানুষের স্বভাব আপন ব্যক্তিগত সুখদুঃখকে বড় করে দেখা – হাতের সামনের আপন হাতের মুঠি হিমালয় পাহাড়কে ঢেকে রাখে।
২৭
বামুনের জাত গেলে প্রায়শ্চিত আছে, আর মুসলমানদের তো জাত যায় না। কিন্তু ইংরেজের জাতিভেদ বড় ভয়ঙ্কর জিনিস। তার দেশে যেরকম কাগজে কলমে লেখা, আইনে বাঁধা কন্সটিটুশন নেই ঠিক তেমনি তার জাতিভেদপ্রথা কোনো বাইবেল-প্রেয়ারবুকে আপ্তবাক্য হিসেবে লিপিবন্ধ করা হয়নি।
২৮
কবিগুরু বাঙালীর অচেনা জিনিস বর্ণনা করতে ভালোবাসতেন না। পাহাড় বাঙলা দেশে নেই – তাঁর আড়াই হাজার গানের কোথাও পাহাড়ের বর্ণনা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। … শীতের দেশের সবচেয়ে অপূর্ব দর্শনীয় জিনিস বরফপাত, রবীন্দ্রনাথ নিদেনপক্ষে সে সৌন্দর্য পাঁচ শ’ বার দেখেছেন, একবারও বর্ণনা করেননি।
২৯
বউকে বেঁধে রাখতে হয় মনের শিকল দিয়ে, হৃদয়ের জিঞ্জির দিয়ে।
৩০
ইতিহাসে দেখেছি, বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাঙলা দেশের বিদ্রোহবিপ্লবও ছেঁড়া কাঁথা গায়ে টেনে নিয়ে ‘নিদ্রা যায় মনের হরিষে’।
৩১
বসকে খুশী করবার জন্য যার ঘটে ফন্দি-ফিকিরের অভাব, তার পক্ষে কোম্পানির কাগজ হচ্ছে তর্ক না করা।
৩২
হঠাৎ মনে পড়ল দার্শনিক দ্বিজেন্দ্র নাথকে কুইনিন খেতে অনুরোধ করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘কুইনিন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনিন সারাবে কে? কুইনিন সরাবে কে?’ তিনি কুইনিন খাননি। কিন্তু আমি মুসলমান – হিন্দু যা করে, তার উল্টো করতে হয়।
৩৩
বুদ্ধের শরণ নিয়ে কাবুলী যখন মগধবাসী হয়নি তখন ইসলাম গ্রহণ করে সে আরবও হয়ে যায়নি।
৩৪
কনফুৎসিয়াস বলেছেন, ‘বাঘ হতে ভয়ঙ্কর কু-রাজার দেশ’, আমি মনে মনে বললুম, ‘তারও বাড়া যবে ডাকু পরে রাজবেশ।
৩৫
আফগান বিয়ের ভোজে যে বিস্তর লোক প্রচুর পরিমাণে খাবে সেকথা কাবুলে না এসেও বলা যায়, কিন্তু তারো চেয়ে বড় তত্ত্বকথা এই যে, যত খাবে তার চেয়ে বেশী ফেলবে, বাঙলা দেশের এই সুসভ্য বর্বরতার সন্ধান আফগানরা এখনো পায়নি।
৩৬
চাকরীতে উন্নতি করে মানুষ হয় বুদ্ধির জোরে নয় ভগবানের কৃপায়। বুদ্ধিমানকে ভগবানও যদি সাহায্য করেন তবে বোকাদের আর পৃথিবীতে বাঁচতে হত না।
৩৭
ভাষা এক হলেই তো আর ভাবের বাজারের বেচাকেনা সহজ সরল হয়ে ওঠে না। শুনেছি, পুরানো বোতলও নাকি নয়া মদ সইতে পারে না।
৩৮
খাঁটি ইসলামে গুরু ধরার রেওয়াজ নেই। পণ্ডিতেরা বলেন, ‘কুরান শরীফ কিতাবুম্মুবীন’ অর্থাৎ ‘খোলা কিতাব’; তাতেই জীবনযাত্রার প্রণালী আর পর-লোকের জন্য পুণ্য সঞ্চয়ের পন্থা সোজা ভাষায় বলে দেওয়া হয়েছে; গুরু মেনে নিয়ে তার অন্ধানুসরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। অন্য দল বলেন, ‘একথা আরবদের জন্য খাটতে পারে, কারণ তারা আরবীতে কুরান পড়তে পারে। কিন্তু ইরানী, কাবুলীরা আরবী জানে না; গুরু না নিলে কি উপায়?
৩৯
পৃথিবীর সব জাত বিশ্বাস করে যে, তার মত ভুবনবরেণ্য জাত আর দুটো নেই। গরীব জাতের তার উপর আরেকটা বিশ্বাস যে, তার দেশের মাটি খুঁড়লে সোনা রুপো তেল বেরবে তার জোরে সে বাকী দুনিয়া, ইস্তেক চন্দ্রসূর্য কিনে ফেলতে পারবে।
৪০
সত্যযুগে মহাপুরুষরা ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, কলিযুগে গণৎকাররা করে।
ভারতবর্ষের সধবারা তাজা মাছ না খেয়ে শুঁটকি মাছের কাঁটা দাঁতে লাগিয়ে একাদশীর দিনে সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় রাখেন।
একটি আট ন’ বছরের মেয়েকে তারই সামনে আমরা একদিন কয়েকজন মিলে অনেকক্ষণ ধরে তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছিলুম-সে চুপ করে শুনে যাচ্ছিল। যখন সক্কলের বলা কওয়া শেষ তখন সে শুধু আস্তে আস্তে বলেছিল, ‘তবু তো আজ তেল মাখিনি।
বিদেশে সম্মান-প্রাপ্ত নৃপতির সম্মান স্বদেশে লাঘব হয়।
তওবা! তওবা! স্ত্রীলোকের জন্য কখনো জব্বর লড়াই হয়? মোক্ষম লড়াই হয় রাইফেলের জন্য। রাইফেল থাকলে সুন্দরীর স্বামীকে খুন করে তার বিধবাকে বিয়ে করা যায়। উত্তম বন্দোবস্ত। সে বেহেস্তে গিয়ে হুরী পেল তুমিও সুন্দরী পেলে। [আফগান দোস্ত মুহম্মদের বয়ানে]