দত্তা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস। ১৯১৮ সালে এটি রচনা করা হয়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় দত্তার নাট্যরূপ বিজয়া। দত্তা একটি চিরাচরিত উপন্যাস। নিজের অমায়িক লেখনিশৈলি দিয়ে গভীরভাবে কাহিনী টি ফুটিয়ে তুলেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বইটি পড়তে পড়তে কখন যে আপনি চরিত্রগুলোকে বাস্তবিক ভাবে কল্পনা করতে শুরু করবেন তা নিজেই বুঝতে পারবেন না।
১
সত্যের স্থান বুকের মধ্যে, মুখের মধ্যে নয়। কেবল মুখ দিয়ে বার হয়েছে বলেই কোনো জিনিস কখনো সত্যি হয়ে ওঠে না। তবুও তাকে যারা সকলের অগ্রে, সকলের উর্ধ্বে স্থাপন করতে চায়, তারা সত্যকে ভালোবাসে বলেই করে না, তারা সত্যভাষণের দম্ভকেই ভালোবাসে বলে করে।
২
জগতের সমস্ত বস্তুই সাফাই সাক্ষীর হাত ধরে হাজির হতে পারে না বলে মিথ্যা বলে ত্যাগ করতে হলে অনেক ভালো জিনিস হতেই আমাদের বঞ্চিত হয়ে থাকতে হয়।
৩
একজনের উচ্ছ্বসিত অকপট প্রশংসার মধ্যে যে আর একজনের কত বড় সুকঠোর আঘাত ও অপমান লুকাইয়া থাকিতে পারে, বক্তা ও শ্রোতা উভয়ের কেহই বোধ করি তাহা মুহূর্তকাল পূর্বেও জানিত না।
৪
অপরাধ যদি কিছু করিয়াই থাকি ত সে তাঁর কাছে। সে দন্ড তিনিই দিবেন; কিন্তু নির্বিচারে যে-কেহ শাস্তি দিতে আসিবে, তাহাই মাথা পাতিয়া লইব কিসের জন্যে?
৫
যা ভাল কাজ, তার অধিকার মানুষ সঙ্গে সঙ্গেই ভগবানের কাছে পায় – মানুষের কাছে হাত পেতে নিতে হয় না।
৬
তারা কেউ বিয়ে করবে না, অনেক অর্থ উপার্জন করবে এবং তাদের সম্মিলিত উপার্জন একসাথে জমিয়ে সামাজিক কাজে ব্যয় করবে।
৭
যাহাকে নির্বোধ বলিয়া গালি দিলে লুকাইয়া হাসে, এবং শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় তদগত হইয়া প্রশংসা করিলে কাঁদাইয়া ভাসাইয়া দেয়, এমন অদ্ভুত প্রকৃতির জীবকে লইয়া সংসারের জ্ঞানীলোকের সহজ কারবার চলে কি করিয়া!
৮
বেলা বাড়িতে লাগিল। কিন্তু যখনই মনে পড়ে সমস্ত কাজকর্মের মধ্যে কোথায় তাহার একটি চোখ এবং একটি কান সারাদিন পড়িয়া আছে, তখন নিজের কাছেই তাহার ভারী লজ্জা বোধ হয়। কিন্তু এ যে কিছুই নয়, এ যে শুধু সেই যন্ত্রটা দেখিবার কৌতূহল, একবার সেটা দেখা হইয়া গেলেই সমস্ত আগ্রহের নিবৃত্তি হইবে, আজ না হয় ত কাল হইবে— এমন করিয়াও আপনাকে আপনি অনেকবার বুঝাইল, কিন্তু কোন কাজেই লাগিল না; বরঞ্চ, বেলার সঙ্গে সঙ্গে উৎকণ্ঠা যেন রহিয়া রহিয়া আশঙ্কায় আত্মপ্রকাশ করিতে লাগিল।
৯
যেদিন বুঝবে রূপটাও মানুষের ছায়া, মানুষ নয়—সেইদিনই শুধু ভালবাসার সন্ধান পাবে।
১০
অথচ এই যে একটা অনাসক্ত উদাসীন লোক আকাশের কোন এক অদৃশ্য প্রান্ত হইতে সহসা ধূমকেতুর মতো উঠিয়া আসিল এবং একনিমেষে তাহার বিশাল পুচ্ছের প্রচন্ড তা তাড়নায় সমস্ত লন্ডভন্ড বিপর্যস্ত করিয়ে দিয়া কোথায় সে নিজে সরিয়ে গেল – চিহ্ন পর্যন্ত রাখিয়া গেল না – ইহা সত্য কিংবা নিছক স্বপ্ন ইহাই বিজয়া তাহার সমস্ত আত্মাকে জাগ্রত করিয়া আজ ভাবিতেছিল। যদি স্বপ্ন হয় সে মোহ কেমন করিয়া কত দিনে কাটিবে, আর যদি সত্য হয় তবে তাহাই বা জীবনে কি করিয়া সার্থক হইবে?
১১
পৌষের মধ্যাহ্নসূর্য ক্রমশঃ এক পাশে হেলিয়া পড়িল; আলোকের চেহারায় দিনান্তের সূচনা দেখিয়া বিজয়ার বুক দমিয়া গেল। কাল যে লোক চিরদিনের মত দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে, আজ সে যদি এতদূরে আসিতে এতখানি সময় নষ্ট করিতে না পারে তাহাতে আশ্চর্য হইবার কি আছে! তাহার শেষ সম্বলটুকু যদি অপর কাহাকেও বেশি দামে বিক্রয় করিয়া চলিয়া গিয়া থাকে, তাহাকেই বা কি দোষ দিবে কে? তাহাদের শেষ কথাবার্তাগুলি সে বার বার তোলাপাড়া করিয়া নিরতিশয় অনুশোচনার সহিত মনে করিতে লাগিল যে মনের মধ্যে তাহার যাহাই থাক, মুখে সে এ সম্বন্ধে আগ্রহাতিশয্য একেবারেই প্রকাশ করে নাই।
১২
সন্তান-ধারণের জন্য যে-সমস্ত লক্ষণ সবচেয়ে উপযোগী তাই নারীর রূপ।
