You are currently viewing একটু উষ্ণতার জন্য উক্তি : ৬০ টি অসাধারণ উক্তি ও লাইন

একটু উষ্ণতার জন্য উক্তি : ৬০ টি অসাধারণ উক্তি ও লাইন

একটু উষ্ণতার জন্য উপন্যাসটি বুদ্ধদেব গুহর একটি বিখ্যাত রোমান্টিক বাংলা উপন্যাস যা ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়।
নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্ক চিরকালীন অথচ চিরজটিল একটি বিষয়। সেই বিষয়কে যারা বহুকোণ হীরকের মতো নানা দিক থেকে বিশ্লেষণের তীব্র আলো ফেলে দেখতে ভালবাসেন, শক্তিমান কথাশিল্পী বুদ্ধদেব গুহ তাদেরই একজন। প্রকৃতি যেমন তাঁর লেখায় প্রবল এক পটভূমি, প্রেমও তেমনই প্রধান এবং জোরালো এক অবলম্বন। এই প্রেম কখনও শরীরী, কখনও শরীরের ঊর্ধ্বে এক স্বর্গীয় অথচ জীবন্ত অনুভূতি । আধুনিক মানুষের প্রেমের সমস্যা আরও অনেক সামাজিক সমস্যার মতোই যে ক্রমশ সূক্ষ্ণ ও বহুধাখণ্ডিত হয়ে উঠেছে বুদ্ধদেব গুহ তা জানেন। জানেন বলেই প্রেমের এত বিচিত্র, গভীর ও বহুবর্ণ রূপ ফুটে ওঠে তাঁর রচনায়।

তাঁর এই নতুন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আধুনিক এক লেখক, যার মানসিক সত্তা খুঁজে বেড়াত সর্ব-অর্থে এক নারীকে, এক প্রকৃত ও সম্পূর্ণ মেয়েকে। ভালবেসে বিয়ে-করা স্ত্রী ক্রমশ সরে গিয়েছিল দূরেম তার সমস্ত অস্তিত্বকে পৌঁছে দিয়েছিল অনস্তিত্বে। এমন সময় জীবনে এল ছুটি। এক অনুরাগিণী পাঠিকা। ধু-ধু তৃষ্ণাতুর জীবনের ছায়া -ঘেরা ওয়েসিসের মতো স্নিগ্ধ ভালবাসার নিমন্ত্রণ হয়ে, হিম-হয়ে যাওয়া হৃদয়ের তাপ সঞ্চারিত করার প্রতিশ্রুতি হয়ে। কিন্তু সত্যি পারল কি? শেষ পর্যন্ত কি সরল এক কি সুখী হতে পারল সুকুমার? জীবনে কি সরল এক অঙ্ক? না তা নয়। এই তীব্র গভীর আশ্চর্য প্রেমের উপন্যাসের জীবনের এক বড়ো সত্যকেই শেষাবধি আবিষ্কার করেছেন বুদ্ধদেব গুহ।

১#

“প্রকৃতিই আমার একমাত্র প্রেমিকা যে আমাকে শুধু আনন্দই দিয়েছে, দুঃখ দেয়নি কোনোরকম; তাই তো মাঝে মাঝে প্রকৃতির ছায়ায় এসে নিজের মনের যত রক্তাক্ত ক্ষত আছে সেগুলোকে সারিয়ে তুলি।”
—বুদ্ধদেব গুহ (একটু উষ্ণতার জন্য)

২#

জীবনে কেউ কাউকে ঠকাতে পারে না, কেউ কাউকে কিছু দিতেও পারে না। যা পাবার, যা দেবার, তা একমাত্র নিজেকেই পেয়ে ও দিয়ে ধন্য বা অধন্য হতে হয়। সে আনন্দ বা দুঃখ শুধু তারই। তার একার। সেই ন্যায় বা অন্যায়ের পাওনা এবং প্রায়শ্চিত্ত শুধু তার নিজেরই‌।

৩#

ভালোবাসা বলতে কি বোঝায় আমি জানি না, উষ্ণতা কথাটার মানে কি আমি জানতে চাইনি, কিন্তু বহুদিন পরে একজনের হাতে হাত রাখতেই আমার সমস্ত শরীর কেন যে এমন করে ভালোলাগায় শিউরে উঠল তাও কি আমি জানি? এই উষ্ণতা, এই আশ্লেষ, এই ভরন্ত ভালোলাগা, এর কি কোনো নাম নেই।

৪#

বয়স হয়ে গেলে সব মানুষই বেশি কথা বলেন, তাঁদের বোধহয় মনে হয় তাঁদের এত কথা বলার ছিল, অথচ বলা হল না। বোধহয় মনে হয়, এখন না বলে ফেললে পরে আর বলা যাবে না।

৫#

অগ্নিসাক্ষী করে কাউকে কোনদিন বিয়ে করেছিলাম বলেই, কাউকে সমস্ত উষ্ণতায় ভরা হৃদয় দিয়ে একদিন ভালোবেসেছিলাম বলেই যে আমার সেই নিবে যাওয়া যজ্ঞের আগুনে সেই ডিপ ফ্রিজে রাখা কোঁকড়ানো ঠাণ্ডা হৃদয়ের কবরে বাকি জীবন হাহাকারে কাটাতে হবে একথা ঠিক নয়।

৬#

অগ্নিসাক্ষী করে কাউকে কোনদিন বিয়ে করেছিলাম বলেই, কাউকে সমস্ত উষ্ণতায় ভরা হৃদয় দিয়ে একদিন ভালোবেসেছিলাম বলেই যে আমার সেই নিবে যাওয়া যজ্ঞের আগুনে সেই ডিপ ফ্রিজে রাখা কোঁকড়ানো ঠাণ্ডা হৃদয়ের কবরে বাকি জীবন হাহাকারে কাটাতে হবে একথা ঠিক নয়।

৭#

সব কথাই কি মুখে অথবা লিখেই জানাতে হয়, এক হৃদয়ের কথা শব্দতরঙ্গে ভেসে কি অন্য হৃদয়ে পৌঁছয় না? যদি নাই-ই পৌঁছয় ত’ কিসের ভালোবাসায় বিশ্বাস করি আমরা, কিসের আন্তরিকতা আমাদের?

৮#

পরনির্ভরতার মত অর্বাচীনতা আর বুঝি নেই। নিজের হৃদয়ের উষ্ণতায়, নিজের মধ্যের জেনারেটরে তাপ সঞ্চারণ করে এই ঠাণ্ডা নির্দয় পৃথিবীতে যে বাঁচতে না পারে, তার বাঁচা হয় না। তার জন্য এই পৃথিবী একটি চলমান প্রাগৈতিহাসিক হিমবাহ।

৯#

কেউই অন্য কারো জন্যে, অন্য কারো কারণে বাঁচে না, অন্তত কারোরই সেরকমভাবে বাঁচা উচিত নয়। কেউই অন্য কারো দয়ায় নির্ভর করে বাঁচতে পারে না। বেঁচে থাকার এবং সুস্থ স্বাভাবিক ও সুখী মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের সকলের জন্মগত নয়, সে অধিকার আমাদের প্রত্যেককে তৈরি করে নিয়ে বাঁচতে হবে।

১০#

জীবন একটা চলমান অভিজ্ঞতা, এতে স্থাবর বা স্থবিরের কোনো স্থান নেই। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই সত্যি। এই মুহূর্তটিই -যে মুহূর্তে আমি বেঁচে আছি। আর সব মিথ্যা। বর্তমানের জন্যে অতীত অথবা ভবিষ্যৎ দুইকেই হাসিমুখে বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে।

১১#

আমাদের মধ্যে নিরানব্বই ভাগ লোকই অতীতের স্মৃতি অথবা ভবিষ্যতের সুখ কল্পনা ‌নিয়ে বাঁচি, মানে বাঁচতে চাই। আর এই বাসি ঠাণ্ডা অতীত ও জরায়ুর মধ্যের ঈষোদুষ্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে পড়ে, তাদের প্রত্যেকের বর্তমানটাই মারা যায়। বর্তমান মানে জাস্ট একটা মুহূর্ত নয়। শুধু এই মুহূর্তই নয়। বর্তমানের বিস্তৃতি অনেক। বর্তমান মানে সমস্ত জীবন, আপনার আমার, সকলের প্রতি মুহূর্তের অস্তিত্ব। আমরা যদি প্রতি মুহূর্তেই নিজেদের ফাঁকি দিই, একে অন্যকে ফাঁকিতে ফেলি, তাহলে সে জীবনের কি বাকি থাকে বলুন?

১২#

আমি এখনও ওকে ভালোবাসি। একে ঠিক ভালোবাসা বলা উচিত কি না জানি না, হয়ত এটা কর্তব্যবোধ, হয়ত এটা অনেকদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে যে যুক্তিহীন মমতা জন্মায় অন্যের প্রতি, তাই। হয়ত এ আমাদের একমাত্র ছেলের প্রতি, তার ভবিষ্যতের প্রতি মমত্ববোধ।

১৩#

অধিকার আমাদের অনেকেরই অনেক ব্যাপারে থাকে হয়ত অনেকের কাছে, কিন্তু সে অধিকারের তাৎপর্য ও তার সীমা আমরা অনেকেই সঠিক বুঝতে পারি না।

১৪#

যদি কারো কাউকে ভালো লাগে ত’ যে-কোনো চেহারায়, যে-কোনো অবস্থায়ই ভালো লাগে। মানে ভালো লাগা উচিত।

১৫#

ডাক্তাররা শুধু শরীরের চিকিৎসা করে, তারা মনের চিকিৎসা জানে না।

১৬#

আসলে প্রত্যেকটা সম্পর্কই বিভিন্ন, তাদের প্রকৃতি, তাদের ডাইমেনশান সব বিভিন্ন। তাই এক সম্পর্কের সঙ্গে অন্য সম্পর্কের তুলনা বোধহয় কখনো করা উচিত নয়।

১৭#

সংসারের জন্যে অনেক কিছু করলে মানুষ স্বাভাবিক কারণে সংসারের কাছে কিছু আশাও করে। এবং মনে হয় সে আশা করাটা কিছু অন্যায় ও নয়। শেষের দিনে যদি এই-ই ঘটে, যখন মানুষ একটু সঙ্গ চায়, একটু সহানুভূতি চায়, তখন যদি তার অশক্ত হাতে তাকে এমন করে বাঁচার জন্যে, নিছক বাঁচার জন্যেই লড়াই করতে হয়, তাহলে এই সংসার-সংসার মিথ্যে পুতুল খেলা খেলে লাভ কি বল?

১৮#

আমাদের সকলেরই জীবনই একএকটা চলমান অভিজ্ঞতা – এতে কোনো জানাই, কোনো মতই স্থিতিশীল নয়। আজ যা নির্ভুল বলে জানছি, কাল সেটাকেই চরম ভুল বলে মনে হয়। আজ যেটাকে চমকপ্রদ বুদ্ধিমত্তা বলে ভাবছি, কালই জানব যে সেটা এক পরম নির্বুদ্ধিতা।

১৯#

আমাদের জীবনে, এই সংসারে আপনার বলতে, নিজের বলতে শুধু একটি জিনিসই আছে। একটি মাত্র জড়পদার্থ। সে জিনিসটা হচ্ছে বাথরুমের আয়না এবং সে আয়নায় প্রতিফলিত তোমার সত্যিকারের ব্যথাতুর মুখ। এটুকুই।

২০#

কেউ কেউ আপনার হয়, আপনার হতে চায়, ক্ষণকালের জন্য, কিছুদিনের জন্য। তুমি যদি সমস্ত জীবনকে ছোট করে হাতের মধ্যে তুলে ধরে একটা বলের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো ত’ দেখবে যে, তুমি ছাড়া, তোমার আয়নায় মুখ ছাড়া, তোমার আপনার বলতে আর কেউই নেই, সত্যিই কেউ নেই।

২১#

এই সংসার একটা দারুণ অর্কেস্ট্রা। কোনো বুড়ো, মান্ধাতার আমলের প্রস্তরীভূত সামাজিক প্রতিভূ একজন কনডাকতারের মতো তার হাতের ছড়ি ওঠায় নামায় এবং তুমি যে বাজনাই বাজাও না কেন, তোমাকে সকলের সঙ্গে একই সুরে, একই লয়ে, একই মাত্রায় বাজাতে হবে। তোমার ভালো লাগুক, কি নাই-ই লাগুক। তোমার তার ছিঁড়ে গেলে তাড়াতাড়ি তার বেঁধে নিতে হবে, হাত শ্লথ হয়ে এলে তবুও অন্যদের সঙ্গে একই সঙ্গে বাজাতে হবে। যদি তুমি থেমে যাও, না বাজাও, সমস্ত অর্কেস্ট্রা তখনই থেমে যাবে।

২২#

যতদিন এই গায়ের উইন্ড-চিটারের মত, আমার বুকের ভিতরের মনের উইন্ড-চিটারটা অক্ষত থাকবে, ততদিনই আমি বাঁচব। আমি কাউকে আমাকে করুণা করতে দেব না, কোন কিছুর জন্যেই নয়।…আমি সশব্দে সমস্ত অনুভূতির তীব্রতার মধ্যে বাঁচতে চাই, মরার সময়েও সচকিত শব্দতার মধ্যে মরতে চাই।

২৩#

মৃত্যু বোধহয় আমাদের একে অন্যের কাছে টেনে আনে। সমস্ত জীবন নিজেদের আত্মম্ভরিতা, নিজেদের ঠুনকো মান, সম্মান, অভিমান নিয়ে আমরা সহজে অন্যের থেকে দূরে থাকতে পারি, কিন্তু মৃত্যু এসে এই সমস্ত মন গড়া ব্যবধান সরিয়ে দেয় – তখন প্রত্যেকেই মনে করি, কি হত কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করলে? কি হত নিজেকে অন্যের কাছে একটু ছোট করলে? দুঃখের কথা এই যে, অন্যজন তার বা তাদের জীবদ্দশায় আমাদের এই সহজ কান্না দেখে যেতে পারে না। মরবার সময়ও বুক ভরা ব্যথা নিয়ে মরতে হয়।

২৪#

সমাজটা যেন একটা চাইনীজ চেকারের ছক। যার যার স্থান, যার যার রঙ সব ঠিক করে দেওয়া আছে। ছকে ছকে পা ফেলে ফেলে এক ছক থেকে আর এক ছকে যে রঙে সমাজ রাঙিয়ে দিয়েছে আমাদের সেই রঙের একটা বল হয়ে গিয়ে এগোতে হবে। তাও এগনো বা পিছনোতেও আমাদের নিজেদের কোনোই হাত নেই। সামাজিক পণ্ডিতরা আমাদের এক ছক থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্য ছকে বসাবে তবেই আমরা এগোতে পারব।

২৫#

যে কোনো লোকের জীবনেই সমস্ত কিছু পয়মন্ততা আর অপয়মন্ততার যোগফল শূণ্য।

২৬#

আমার কখন কি করি, কেন করি, তা কি আমরা জানি? জীবনের কোন্ ঘটনা কেমন করে, কখন যে আমাদের মনের গোপন তারে কিভাবে নাড়া দিয়ে যায়, তা সবসময় আমরা নিজেরাই কি জানতে পাই?

২৭#

জীবনের কোনো সম্পর্কই চিরদিনের নয়। সব সম্পর্কই বাঁচিয়ে রাখতে হলে, ফুলের গাছের মতো তাতে জল দিতে হয়, যত্ন করতে হয়।

২৮#

রাতের কোনো তারাই কি দিনের আলোর গভীরে থাকে? থাকেও যদি, তাহলে আমার লাভ কি যদি নাই-ই দেখতে পেলাম? নাই-ই চিনতে পেলাম? তাহলে থাকল কি না থাকল তাতে আমার কি আসে যায়?

২৯#

কাজ আছে বলেই হয়ত আমার মত অনেক হতভাগ্য পুরুষ বাইরের জগতের কৃতিত্বের মেডেল বুকে ঝুলিয়ে, হাহাকার তোলা আন্তর্জগতে সস্তা জাদুকরের মতো এখনও বেঁচে আছে, বেঁচে থাকে, এই নির্দয় সহানুভূতিহীন পৃথিবীতে। যেদিন আমার কাজ থাকবে না, সেদিন আমাদের বাঁচাও আর হবে না। আমাদের মতো লোকের বাঁচার সেদিন কোনো মানে থাকবে না।

৩০#

সব উষ্ণতাই একদিন নিভে যায়। সমস্ত উষ্ণতার স্বাদ উষ্ণতার সাধ, সব‌ নিঃশেষে নিয়মিত এই আমোঘ পরিণতির দিকে গড়িয়ে যায়ই যায়।

৩১#

আমার এতদিন মনে হয়েছিল এমন পুরুষও থাকে, আছে, যার কোনো নারীর হাতের উষ্ণতার জন্য কাঙালপনা না করলেও চলে। আজ নিশ্চিতভাবে জানলাম, আমি যা ভাবতাম, তা ঠিক নয়। কোনো পুরুষই বোধহয় কোনো ভালোবাসার নারীর সঙ্গ ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। সে সব পুরুষ, মানুষ হিসেবে কখনই সম্পূর্ণ নয়।

৩২#

যার সম্বন্ধে মনে মনে একটা ধারণা গড়ে উঠেছে সে ধারণা নিজে থেকে না ভাঙলে অন্য কেউ এমন করে ভাঙতে পারে না।

৩৩#

বিয়ের এই সম্পর্কটা ত কোনো তেজারতি কারবারের মুচলেকা নয় যে যা কবুল করেছি, তা না দিতে পারলেই জেল হবে। আইন আদালতে যাবার অনেক আগেই এ সম্পর্কের ফয়সালা হয়ে যায়। দুজনের মনে সে মুহূর্তে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, সেই মুহূর্তেই সেই সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তারপর যা বাকি ছিল, তা শুধু নিজেদের নিজেরা ঠকানো। অভিনয়, সংস্কার, লোকভয়, এসব ভেঙে বেরিয়ে আসার সাহসের অভাব।

৩৪#

জীবনে এমন অনেক থাকা থাকে যা থাকাকালীন তাদের অস্তিত্ব বা দাম আমরা বুঝতে পারি না। হয়তো কেউই পারে না। যখন তা আর আমাদের থাকে না, তখনই টুকরো টুকরো কথা, বাসি ফুলের গন্ধের মতো চাপা স্মৃতি ফিরে ফিরে মনে আসে।

৩৫#

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে, যা কখনও ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলা যায় না। সেই সম্পর্কটা যখন হঠাৎ শেষ হয়ে যায়, তখন অত্যন্ত নির্দয় মানুষের মনও দারুণভাবে দ্রবীভূত হয়ে পড়ে। অথচ সম্পর্ক যখন শেষ হয় নিজেদের ইচ্ছায়, তখন তা নিয়ে কিছুমাত্র খেদ থাকার কথা নয় কারো মনেই, অথচ আশ্চর্য। তবুও খেদ থাকে। বড় খেদ থাকে।

৩৬#

নীরবতাও একরকমের জবাব। প্রত্যেক নীরবতার মধ্যেই অনেক সশব্দ সাহসী উত্তর চাপা থাকে।

৩৭#

সময় কেউ কাউকে দিতে পারে না। সময়ও হচ্ছে জলের মতো। সময়কে নিজে হাতে শূন্য না করলে জলের মতই সময় চতুর্দিকে গড়িয়ে যায়। সময় কারো জন্যেই বসে থাকে না।

৩৮#

সকল মানুষই জীবনে এমন কোনো-না-কোনো মুহূর্তের সম্মুখীন হয় যখন তার কিছুতেই আর কিছু মাত্র যায় আসে না।

৩৯#

আমাদের সকলের সামনেই সন্ধ্যে হয় রোজ কিন্তু আমরা ক’জন সেদিকে চোখ তুলে তাকাই? দিনের শেষ এবং রাতের শুরুর মধ্যে এই যে গোধূলি লগন, এই লগনকে আমরা ক’জন উপলব্ধি করি?

৪০#

মাঝে মাঝে আমাদের চোখ এত কথা বলে, চুপ করে কারো দিকে চেয়ে থাকলে চোখ অনর্গল এত বলে যে, সে সময়ে মুখে কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না। আমাদের কলমের বা মুখের ভাষা কোনোদিনও বোধহয় চোখের ভাষার সমকক্ষ হতে পারবে না।

৪১#

আমার এই সমস্ত রকম আপাতপ্রাপ্তির মধ্যেও কেন মন আমার সর্ব সময় এমন অশান্ত থাকে? কেন এমন পাগলের মত ছটফট করে? না কি, আমি একাই নই, সবাই-ই এরকম, প্রত্যেক মানুষ ও মানুষীর মনের ভিতরেই বুঝি এমনি একটা মন থাকে, যে মনটা প্রতিটি মুহূর্তে বিদ্রোহীর মত মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, যা পেল, তাকে ধূলোয় ফেলে অন্য কিছুর দিকে হাত বাড়ায়?

৪২#

জীবন কি সত্যিই এত অবহেলার জিনিস? জীবন তা একটাই- একবারই আসে। তবে সে জীবনও আমরা নিজেদের ইচ্ছা নিজেদের সাধ অনুযায়ী ভোগ করতে পারি না কেন?

৪৩#

আমরা প্রত্যেকেই বোধহয় অনেক পরত ভঙ্গুর ভাবাবেগ নিয়ে জন্মাই, বড় হই, হয়ত সেটাই স্বাভাবিক। তারপর এই জীবনের ছায়াময় রুক্ষ পথে চলতে চলতে, বাড়তি পোশাকের মতো, এক এক পরতকে পথে ফেলে যেতে থাকি।

৪৪#

লক্ষ লক্ষ বিবাহিত দম্পতি এমনি করে দাম্পত্যের অভিনয় করে চলেছেন, ক্লাবে, পার্টিতে, সামাজিক উৎসবে। সকলের সামনে ভাব দেখাচ্ছেন। কত প্রেম। হাসছেন, একে অন্যকে ডার্লিং বলছেন, তারপর বাড়ি ফিরে এয়ার কন্ডিশনড বেডরুমে মোটা ডানলোপিলোর গদির উপর দুটি প্রাণহীন মোমের মূর্তির মতো দুজন দুদিকে শুয়ে থাকছেন। গায়ে গায়ে লেগে থেকেও হাজার মাইল ব্যবধানে আছেন।

৪৫#

তোমার আমার চারপাশের লোকদের যদি তেমন করে লক্ষ্য কর, ত’ দেখবে যে, তাদের বেশির ভাগের মনই স্যানফোরাইজড্। তাদের মনে কোনো সংকোচন প্রসারণ নেই। তাদের মনের পাল যেমন ছিল তেমনিই থাকে, হাওয়া লাগলেও ফোলে না, দোলে না, হাওয়া না লাগলেও চুপসোয় না, কুঁকড়ে গুটোয় না। তারা তাদের মনকে জীবনের সঙ্গে কন্ডিশানড করে নিয়েছে। এয়ার কন্ডিশনড ঘরের মতো। সেখানে শীতে-গ্ৰীষ্মে একই তাপ।

৪৬#

প্রত্যেকের সুখ আলাদা আলাদা রকম। সুখের নিজস্ব কোনো চেহারাই নেই, সুখ যেমন তরল পদার্থের মত – যে মানুষের মনের যেমন আয়তন, যেমন পরিধি, যেমন ঘনতা, সুগ ঠিক সেই আকার ধারন করে। কাজেই যারা এমোশনকে জীবন থেকে বাড়তি পোশাকের মতো ফেলে দিয়েছে তারা তাদের মত সুখী, আবার তুমিও তোমার মত সুখী। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমরা সকলেই সুখী এবং সকলেই দুঃখী।

৪৭#

এখনও বেলা আছে, এখনও সকালের আশাবাদী রোদ আছে, এখনও পথ আছে ফেরার।

৪৮#

জীবনে আনন্দ কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সুখও নয়, এই দুঃখ, এই একাকীত্ব, এই মনে মনে আত্মহননের অনুক্ষণ চিন্তা পেরিয়ে এলে কখনও হঠাৎ আনন্দের উষ্ণ হাতে হাত রাখা যায়। কিন্তু শুধু কিছুক্ষণের জন্যই।

৪৯#

আমি বিশ্বাস করি না যে মিথ্যাকে বা ভানকে আশ্রয় করে জীবনে কিছু পাওয়া যায়। পাওয়া যে যায় না, তা নয়, কিন্তু তা নিতান্তই মেকী, স্বল্পস্থায়ী, তাতে আনন্দ‌ নেই। যে কোনো গভীর আনন্দই গভীর দুঃখ থেকে জন্মায়। গভীরতা ‌না থাকলে দুঃখ বা সুখ কোনোদিনই তেমন করে নিজেকে আচ্ছন্ন করে না বলেই মনে হয়।

৫০#

অন্যকে দুঃখ দিয়ে কি কখনও সুখী হওয়া যায়? সত্যিকারের সুখী হওয়া যায়? সুখ কেউই কাউকে হাত বাড়িয়ে দেয় না। আজকের দিনে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হাতে নিজের সুখ নিজেকেই কেড়ে নিতে হয় অন্যের অনিচ্ছুক হাত থেকে। যে তা না করে, সে মরে।

৫১#

জীবনটা এত ছোট, অবকাশের সময় এত কম যে, বেশী লোকের মধ্যে, বেশী লোকের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দিলে কোনো সম্পর্ককেই গভীর ভাবে উপভোগ বা উপলব্ধি করা যায় না বলেই সবসময় মনে হয়েছে।

৫২#

আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি সম্পর্কই যেন হীরের টুকরোর মতো। কোনদিক থেকে, কোন্ কোণ থেকে আলো পড়লে মনের সম্পর্কের কোন্ কোণে কোন্ রঙ ঝিলমিলিয়ে ওঠে তা বোঝা শক্ত।

৫৩#

এ জীবনে কখনও ভুলে ও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু কোরো না। যা মন থেকে, হৃদয় থেকে করতে না চাও তা কখনও কোরো না। কারো কথাই শুনো না, বিবেকের না, সমাজের না…

৫৪#

জীবনে যা নিজের বিদ্যা, বুদ্ধি এবং বোধ দ্বারা বিবেচনা করেছ, করে ফেলেছ, কখনও তা নিয়ে আফশোস কোরো না। যাই করো না কেন, যা করেছ, তার জন্যে কারো কাছে ক্ষমা চেও না, নিজেকে অভিশাপ দিও না। যা করেছ, তা ঠিকই করেছ বলে মনে কোরো। সব সময় মনে কোরো।

৫৫#

জীবন একটা সমুদ্রের মতো, বিশাল, দিগন্তবিস্তৃত, আবর্তময়। এ এক মত্ততায় ভরা ঢেউয়ের সমুদ্র ঢেউ, তারপর ঢেউ তারপর আরো ঢেউ। এখানে অনেক ফেনা, ডুবে যাওয়া, পাথরে আছরে পড়া আবার আশ্চর্য নীল – শান্তও কখনও কখনও। সত্যিই জীবন একটা দারুণ গোলমেলে নোনা স্বাদে ভরা দুরন্ত অভিজ্ঞতা। আর আমরা, আমরা এই টুকরো টুকরো ক্ষুদ্র মানুষ সেই সমুদ্রের বুকে ওড়া ছোট নরম সাদা সীগালেদের মতো।

৫৬#

যে কাউকে জীবনে তেমন করে ভালোবেসেছে এবং ভালোবেসে ভালোবাসার জনকে পায় নি, একমাত্র সেই-ই জানে সেই ব্যর্থতার গ্লানি ও কষ্ট কি এবং কতখানি।

৫৭#

ভালোবাসা হচ্ছে তীরের মত। তূণ থেকে বেরিয়ে চলে গেলে সে চলেই যায়, তার লক্ষকে বিঁধতে পারে কি না পারে তা সেই তীরন্দাজের কপাল।

৫৮#

জীবনে অনেককেই এমন কতগুলো সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয় যে সব সঙ্কটে অন্য কেউই তোমাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারে না। তোমার কষ্ট দেখতে পারে, মনে মনে তোমার প্রতি সমবেদনা জানাতে পারে, কিন্তু সাহায্য করতে পারে না। এই সঙ্কট থেকে পেরুতে যা করবার তা তোমাকেই করতে হবে।

৫৯#

যারা ভালোবাসে ভালোবাসার জনকে পায় না, তাদের সবচেয়ে বড় জিত বুঝি এইখানে। এই না-পাওয়াও একটা দারুণ পাওয়া।

৬০#

ব্যর্থ প্রেম বা ব্যর্থ প্রেমিক বলে কোনো কথা কখনও আছে বা ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি না। প্রেম, সে যার প্রেমই হোক, সে যদি সত্যিকারের প্রেম হয় তা কখনই ব্যর্থ হয় না। প্রেমের সমস্ত সার্থকতা প্রেমাস্পদকে পাওয়ার মধ্যেই সীমিত নয়। তাকে পাওয়া যেতে পারে, নাও যেতে পারে। প্রেমের সবচেয়ে বড় গৌরব প্রেমই। মানুষের জীবনে আর কোন অনুভূতিই তাকে এমন এক আত্মিক উন্নতির চৌকাঠে এনে দাঁড় করায় না। যে ভালোবাসে সে নিজের অজানিতে কখন যে নিজের মনের আঁটসাঁট গরীব কাঠামোর চেয়ে অনেক বড় হয়ে যায়, সে নিজেও তা বুঝতে পারে না। অন্য কোনো অনুভূতিই তাকে এমন করে মহৎ, উদার ও উন্নত করে না। ভালো যে বাসে, সে ভালোবেসেই কৃ্তার্থ হয়; যাকে ভালোবাসে তার কৃপণতা বা উদারতার উপর তার ভালোবাসার সার্থকতা কখনও নির্ভরশীল হয় না।

তবুও মেতে হবে, চলে যেতে হবে, আজ কিংবা কাল, নিজের হাতে নিজেকে খেয়া পার করাতে হবে। … পাখি ডাকবে, ফুল ঝরে পড়বে, শুকনো পাতা উড়বে চৈতী হাওয়ায়, মহুয়া আর করৌঞ্জের গন্ধে ভারী হয়ে থাকবে সমস্ত প্রকৃতি – আর এই দ্বন্দ্ব ও দ্বিধায় ক্লিষ্ট বঞ্চিত ও ব্যথিত হৃদয়ের একজন চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকবে।

Leave a Reply