You are currently viewing অপরাজিত উপন্যাসের উক্তি

অপরাজিত উপন্যাসের উক্তি

অপরাজিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস। ‘প্রবাসী’ মাসিকপত্রে ১৩৩৬ সালের পৌষ সংখ্যা থেকে ১৩৩৮- এর আশ্বিন সংখ্যা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসের স্ফীতির কারণে দু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে প্রথম বের হয়ঃ প্রথম ভাগের প্রকাশকাল মাঘ ১৩৩৮ (এপ্রিল ১৯৩২), দ্বিতীয় ভাগের প্রকাশকাল ফাল্গুন ১৩৩৮ (মে ১৯৩২)। এবারেও প্রকাশক ছিলেন সজনীকান্ত দাস, বের করা হয়েছিল রঞ্জন প্রকাশালয় থেকে এবং দাম ছিল যথাক্রমে দু টাকা চার আনা ও দু টাকা। পরে ‘অপরাজিত’ দু খণ্ডের জায়গায় এক খণ্ডে মুদ্রিত হয়, এখনও তাই হচ্ছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছিলেন ‘মাতৃদেবীকে’।

‘অপরাজিত’ সাময়িকপত্রে মুদ্রণের আগে লেখকের পরিকল্পিত নাম ছিল ‘আলোর সারথি’, কিন্তু ‘প্রবাসী’ তে ছাপানোর সময়েই শিরোনাম পরিবর্তন করে ‘অপরাজিত’ রেখেছিলেন।

১#

একশত বৎসর একসঙ্গে থাকিলেও কেহ হয়তো আমার হৃদয়ের বাহিরে থাকিয়া যায়, যদি না কোনো বিশেষ ঘটনায় সে আমার হৃদয়ের কবাট খুলিতে পারে।

২#

যে স্বাধীনতার স্বাদ সে দীর্ঘদিন যাবৎ পেতে চেয়েছিলো, সে স্বাধীনতার অবারিত দুয়ার তার সামনে খোলা অবস্থায় দাঁড়িয়ে।

৩#

জীবনকে খুব কম মানুষেই চেনে। জন্মগত ভুল সংস্কারের চোখে সবাই জীবনকে বুঝিবার চেষ্টা করে, দেখিবার চেষ্টা করে, দেখাও হয় না, বোঝাও হয় না। তাছাড়া সে চেষ্টাই বা ক’জন করে?

৪#

প্রকৃতির সুন্দরি, তুমি যেন নিজের সুন্দরি।

৫#

সে নিজে বেশ বুঝতে পারে, এই এক বৎসরে তাহার মনের প্রসারতা এত বাড়িয়া গিয়াছে, এমন একটা নতুনভাবে সে জগৎটাকে, জীবনটাকে দেখিতে আরম্ভ করিয়াছে…
সে এটুকু বেশ বোঝে, কলেজে পড়িয়া ইহা হয় নাই, কোনো প্রফেসরের বক্তৃতাতেও না- যাহা কিছু হইয়াছে, এই বড় আলমারি ভরা লাইব্রেরিটার জন্য, সে তাহার কাছে কৃতজ্ঞ। সে যতক্ষণ লাইব্রেরিতে থাকে, ততক্ষণ তাহার খাওয়াদাওয়ার কথা তত মনে থাকে না। এই সময়টা এক একটা খেয়ালের ঘোরে কাটে। খেয়ালমত এক একা বিষয়ে প্রশ্ন জাগে মনে, তাহার উত্তর খুজিতে গিয়া বিকারের রোগীর মত অদম্য পিপাসায় সে সম্বন্ধে যত বই পাওয়া যায় হাতের কাছে- পড়িতে চেষ্টা করে।

৬#

যুগে যুগে অপরাজিত জীবন-রহস্য কি অপূর্ব্ব মহিমাতেই আবার আত্মপ্রকাশ করে!

৭#

দুঃখের নিশীথে তাহার প্রাণের আকাশে সত্যের যে নক্ষত্ররাজি উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে- তা সে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়া যাইবে… আজিকার দিন হইতে অনেকদিন পরে—হয়ত শত শত বৎসর পরে তাহার নাম যখন এ-বছরে-ফোঁটা-শালফুলের মঞ্জরীর-মত-কোথায় মিলাইয়া যাইবে,… তখন তাহার কত অনাগত বংশধর কত সকলে, সন্ধ্যায়, মাঠে, গ্রাম্য নদীতীরে, দুঃখের দিনে, শীতের সন্ধ্যায় অথবা অন্ধকার গহন নিস্তব্ধ দুপুর-রাত্রে, শিশির-ভেজা ঘাসের উপর তারার আলোর নিচে শুইয়া শুইয়া তাহার বই পড়িবে— যে বিশ্বের সে একজন নাগরিক, তা ক্ষুদ্র, দীন বিশ্ব নয়-লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ যার গণনার মাপকাঠি, দিকে দিকে অন্ধকারে ডুবিয়া ডুবিয়া নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকদের দেশ, অদৃশ্য ঈথারের বিশ্ব যেখানে মানুষের চিন্তাতীত কল্পনাতীত দূরত্বের ক্রমবর্ধমান পরিধিপানে বিস্তৃত –সেই বিশ্বে সে জন্মিয়াছে… কত নিশ্চিন্দিপুর, কত অপর্ণ, কত দুর্গ দিদি-জীবনের ও জন্মমৃত্যুর বীথিপথ বাহিয়া ক্লান্ত ও আনন্দিত আত্মার সে কি অপরূপ অভিযান… শুধু আনন্দে, যৌবনে, জীবনে, পুণ্যে ও দুঃখে, শোকে ও শাস্তিতে। …এই সবটা লইয়া যে আসল বৃহত্তর জীবন–পৃথিবীর জীবনটুকু যার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র… সে জীবনের অধিকার হইতে কাহারও বঞ্চনা করিবার শক্তি নাই—তার মনে হইল সে দীন নয়, দুঃখী নয়, তুচ্ছ নয়—এটুকু শেষ নয়, এখানে আরম্ভও নয়। সে জন্ম-জন্মান্তরের পথিক-আত্মা, দূর হইতে কোন সুদূরের নিত্য নূতন পথহীন পথে তার গতি, এই বিপুল নীল আকাশ, অগণ্য জ্যোতিলোক, সপ্তর্ষিমণ্ডল, ছায়াপথ, বিশাল অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার জগৎ বহির্ষদ পিতৃলোক—এই শত সহস্ৰ শতাব্দী তার পায়ে-চলার পথ—তাঁর ও সকলের মৃত্যু দ্বারা অস্পষ্ট সে বিরাট জীবনটা নিউটনের মহাসমুদ্রের মত সকলেরই পুরোভাগে অক্ষুন্নভাবে বর্তমান-নিঃসীম সময় বাহিয়া সে গতি সারা মানবের যুগে যুগে বাধাহীন হউক।
― অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply