পার্থিব প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রচিত একটি উপন্যাস। জীবন কেন, এই জীবনের অর্থ কী, কেনই-বা শুধুমাত্র বেঁচে থাকা? নাকি এর গভীরে নিহিত আছে কোনও হিরন্ময় তাৎপর্য?—এমন নানা প্রশ্নে আকীর্ণ বস্তুগ্রাহ্য এই জগৎ ও জীবন। সাহিত্যে ধ্রুপদীয়ানার সনিষ্ঠ সেবক শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়ের এই বৃহদায়তন উপন্যাসে এই সমূহ সনাতন প্রশ্নেরই স্থির উত্তর-অন্বেষণ। আর দশটা উপন্যাসের মতােই এই উপন্যাসেরও উপকরণ কিছু চরিত্র আর কিছু ঘটনা, সেইসঙ্গে মানুষের অভ্যন্তরে প্রবহমান চৈতন্যের গুঢ়, গভীর স্রোত। তবু শাশ্বত সাহিত্যে যেমন, এখানেও তেমনই, এক গভীর দ্যোতনা এ-কাহিনীর শুরু ও শেষকে তাে বটেই, এমনকি পুরাে কাহিনীকেও এক সময় অতিক্রম করে যায়। এখানেই এর সার্থকতা ও অনন্যতা।
১#
মেয়েদের চারদিকে পাপের হাজারো পথ। যেদিকেই পা বাড়ত্তি, শথ-পায়ের নিচে হাজির হয়ে যায়।
২#
ভালবাসার জিনিসকে বাঁচাতে মানুষ সব করতে পারে।
৩#
মাইনে মানেই দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ সমন্বিত টাকা। সীমাবদ্ধ। বুদ্ধিমান মানুষ কখনও সীমাবদ্ধ টাকার ওপর নির্ভর করে বড়লোকী করতে যায় না।
৪#
নারীর প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা এবং তাঁদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা খুবই ভাল। কিন্তু আতঙ্ক থাকা ভাল নয়।
৫#
চোর ডাকাতেরা আগে বাইরে থেকে আসত। আজকাল সব গা ঘেঁষেই বসত করে। এমন কি আমাদের মধ্যেই গজিয়ে ওঠে।
৬#
ব্রেন’না থাকা খুব ভাল। ব্রেনলেসরাই জগতে সুখী।
৭#
কিন্তু মায়া জিনিসটা ভাল নয়। একদম ভাল নয়। মায়াও একধরনের পরাধীনতা, এক ধরনের স্বাধীনতার অভাব, মুক্তির প্রতিবন্ধক।
৮#
এ আমলের লোকেরা বোধ হয় শব্দ ভালবাসে। কেবল শব্দ আর শব্দ।
৯#
প্রত্যেক মানুষের রক্তেই একটা ফিরে যাওয়ার টান আছে। কিন্তু যেতে পারে না। শহর বেঁধে রাখে।
১০#
মানুষের সব চেয়ে বড় শত্তুর হল তার মন।
১১#
ভীষণ রাগী। তার মানে ইউ হ্যাভ এ পারসোনালিটি। ওটা সকলের থাকে না। রেয়ার।পারসোনালিটি মিনস্ স্ট্রং লাইকস্ অ্যান্ড ডিজলাইকস্।
১২#
যারা স্ট্রং পারসোনালিটির হয় তারা কিন্তু একটু লোল্লি। চট করে কারও সঙ্গে মিশতে পারে না তো। তাই দে আর ন্যাচারালি লোনি সোলস্।
১৩#
ঘুমও কি ছোট করে মরণ? ঘুমোলে তো শরীরের বোধ মুছে যায়, সমাজ সংসার, আত্মীয়স্বজন সব মুছে যায়। মরণও তাই। তবে কি নিত্যি দিন ঘুমের মধ্যে আমরা একটু একটু করে মরি!
১৪#
বুড়োরা যখন একে একে কেটে পড়তে থাকে তখন বেঁচে-থাকা বুড়োদের বড্ড একা লাগে। ভয়-ভয়ও করে।
১৫#
খিদে থাকবে না কেন? এ কি বড়লোকের পেট? গরিবের পেটে সবসময়ে খিদে।
১৬#
ব্যথাতুর দিন সবচেয়ে ধীরে কাটে। কাটতেই চায় না। এক একটা সেকেন্ড যেন একটি একটি ঘণ্টা। এক একটি ঘণ্টাই যেন এক একটি দিন বা মাস। আর দিন যেন বছর বা দশক বা কল্পান্ত।
১৭#
মরে কোথায় যাবে? বিষ্ণুপদ একটু হাসল, মানুষের বিদ্যেতে এত কিছু আছে, অথচ এ প্রশ্নটার জবাব নেই রে ভাই। কোথায় সে যায়। নাকি কিছুই থাকে না। কে জানে!
১৮#
মরে গিয়েও মানুষের কিছু থাকে। সবটা শেষ হয়। না। কিছু একটা থেকে যায়।
১৯#
ম্যারেজ থেকেই তো ফ্যামিলি, আর ফ্যামিলি থেকে ক্ল্যান। পরিবার হল মানুষের ভিড়। তার শিকড়। পরিবার না থাকলে মানুষ পরগাছার মতো হয়ে যায়, যাযাবরের মতো জীবনযাপন করে।
২০#
মন বড় বিচিত্র এক জিনিস। কিছুতেই তার টিকির নাগাল পাওয়া যায় না। মন কতভাবে যে নাকাল করে বেড়ায় মানুষকে।
২১#
এ দেশে যার যা আছে বা নেই সবাই সেই আছে বা নেইকে একটা ব্যাপারেই লগ্নি করতে চায়। সেটা হল ভিক্ষে। যার একটা হাত নেই সে সেই নেইটাকে ভিক্ষের কাজে লাগায়। ভিক্ষে করতে কে আমাদের শেখাচ্ছে জানেন? আমাদের সরকার। সরকার নিজেই পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্লজ্জ ভিখিরি।
২২#
মদ খেলেই ভিতরের নানারকম জমে থাকা বিষ গালাগাল হয়ে বেরিয়ে আসে। তখন আরাম পায়।
২৩#
অনেক সময়ে সামান্য হাঁটা পথও লক্ষ বছরে পেরোতে পারে না মানুষ।
২৪#
প্রেমে পড়লে কিন্তু লোকের মাত্রাজ্ঞান থাকে না। কাণ্ডজ্ঞানও নয়।
২৫#
ধারালো মেয়েরা আজকাল ইচ্ছে করেই ব্যক্তিত্বহীন, ম্যাদাটে মার্কা, জো-হুজুর টাইপের পুরুষদের পছন্দ করছে। তাতে তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বজায় থাকে, যা খুশি করতে পারে, স্বামীকে ইচ্ছেমতো চালাতে পারে।
২৬#
এ দেশের গাঁড়ের লোকের দুটি জিনিসের খুব অভাব। সময় আর দূরত্বের আন্দাজ।
২৭#
গাঁয়ের দুঃখ কী জানিস? যারা ভাল কিছু করে তারা আর গাঁয়ে থাকে না।
২৮#
যারা রোজ ভালমন্দ খেয়ে বড় হয় তারা খাবারের স্বাদই পায় না।
২৯#
প্রেমিক প্রেমিকারা কত ভালবাসার কথাটথা বলে ঘর বাঁধে, তারপর তাদের ঝগড়ার জ্বালায় বাড়িতে কাকপক্ষী বসতে পারে না।
৩০#
মানুষের একটা অনাবিষ্কৃত গুণ হঠাৎ আবিষ্কৃত হয়ে তাকে চোখের পলকে বিশ্ববিখ্যাতও করে তুলতে পারে। কিন্তু আবিষ্কার হওয়াটাই হচ্ছে প্রথম কথা।
৩১#
এ দেশে থানা পুলিশ নিলাম হয়, বুঝলে? যার দর যত বেশী ওঠে, পুলিশ গিয়ে তার কাছে স্বয়ংবরা হয়।
৩২#
বীণাপাণি, বেকার লোকদের কোনও মতামত থাকে না। সে হল খাঁচায় পোষা পাখি।
৩৩#
এ দেশে বাস করে কয়েক কোটি ভেড়া আর কয়েকটা বাঘ। এক লক্ষ ভেড়াও একটা বাঘ দেখলে পালায়।
৩৪#
মরে গেলে তো আরও চমৎকার শাস্তি, একদম ঠাণ্ডা। বেঁচে থাকাটা কিন্তু নিছক শান্তি নয়।
৩৫#
গল্প উপন্যাস মানুষকে অনেক বেশী কনশাস করে তোলে।
৩৬#
যত বুড়ো হবে তত একা!
৩৭#
এই যে আতা দেখছিস, বিচিতে ভরা। গিজ গিজ করছে বিচি। বিচি ফেলে তবে আতার মাখনটুকু খেতে হয়। তাই না? মানুষের জীবনটাও তেমনই মেলা বিচি। ওসব বাদছাদ দিয়ে তবে খেতে হয়।
৩৮#
যতদিন পারো শৈশবকেই ধরে রাখো। শৈশবের মতো সুন্দর সময় আর নেই। বড় হলে দেখবে পৃথিবীটা একদম বিচ্ছিরি।
৩৯#
মেয়েমানুষের মস্তর হল টাকা। যখনই লাফঝাঁপ করবে কিছু টাকা ছেলে দাও, মুখে কুলুপ।
৪০#
যারা চাকরির মধ্যে স্বাধীনতা খোঁজে তনা কেন বোঝে না যে চাকরিটাও অধীনতা?
৪১#
আচ্ছা, এত ছোটো, এত সামান্য হয়ে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় নাকি? আমি তো একটু সুন্দর, একটু মেধাবীও হতে পারতাম। কিংবা আরও স্মার্ট!
৪২#
সেন্টিমেন্ট এক মস্ত জিনিস। খুব মূল্যবান। লোকে কেন যে আজকাল আর এর মূল্য দেয় না।
৪৩#
দুনিয়াটায় এখন টাকা আর মেয়েমানুষ ছাড়া যেন কিছু নেই। আর একটা জিনিসও দেখি, খুব বেড়েছে নেশা।
৪৪#
গরিবের মন বলে কিছু থাকে না। কতগুলো দারিদ্র্য আছে এতই খারাপ যে, মানুষকে নষ্ট করে দেয়।
৪৫#
শোক তো পুকুরে ঢিল। ধীরে ধীরে ঢেউ মরে যায়। আবার নিথর হয়ে যায় জল
৪৬#
জীবনটা ক্ষণস্থায়ী বলেই কিছুটা সুন্দর।
৪৭#
খিদেটা হল বেঁচে থাকার লক্ষণ। খিদে প্রায় মানে বেঁচে আছে।
৪৮#
ভালবাসা একটা এমন জিনিস যা সব জ্ঞানকে গ্রাস করে নিতে পারে।
৪৯#
বাঙালিদের প্রেম হল সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার আর বিয়ে হল মস্ত কীর্তি। ব্যস জীবনের সব সার্থকতা হয়ে গেল।
৫০#
এদেশে এখনও মেয়েরা নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করতে পারে না। তাদের কেউ পছন্দ করলে, দরাদরিতে বনিবনা হলে তবেই বিয়ে।
৫১#
দুনিয়াতে পালিয়ে যাওয়ার আর জাগা নেই। পালাতে হলে নিজের মধ্যে পালাবি।
৫২#
জীবনের ভুলগুলো মানুষ যতদিন নিজে না বুঝতে পারে ততদিন তাকে ফেরাকে চেষ্টা করে লাভ হয় না। ওটা হল নিশির ডাকের মতো।
৫৩#
যদি এই পোশাক বদলের মতো মনটাকেও বদলে ফেলা যেত।
৫৪#
ব্যক্তিত্বহীন মানুষদের সঙ্গ বেশিরভাগ মানুষই পছন্দ করে। কেননা, তারা সব কথাতেই সায় দেয়, অকারণে অন্যায্য প্রশংসা করে এবং হাবিজাবি কথাও মন দিয়ে শোনে। মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো চালানোর জন্য এসব লোককে সবসময়েই সঙ্গী হিসেবে চায়। মানুষের ইচ্ছাপূরণে সাহায্য করে বলেই কিছু দয়া ও দাক্ষিণ্য তারা পেয়ে থাকে।
৫৫#
আসল শয়তান কারা হয় জানো? যাদের মাথা সবসময়ে ঠাণ্ডা, হাসি-হাসি মুখ, আর মনে জিলিপির প্যাঁচ। ওকে বাইরে থেকে দেখ, কেমন ভালমানুষটি।
৫৬#
আমরা কেউ কোনও অবস্থাতেই স্বাধীন নই। স্বাধীনতা একটা রিলেটিভ ধারণামাত্র। এক ধরনের আই ওয়াশ। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানেই চাকরির অধীনতা, সেখানেও হুকুম করার লোক আছে, বাধ্যবাধকতা আছে। পুরো স্বাধীনতা কোথাও নেই।
৫৭#
মেয়ে হয়ে জন্মেছি, আর কাঁদবো না, তাই কি হয়? কাঁদতেই তো জন্মায় মেয়েরা।
৫৮#
মায়েরা তো সব ক্ষমার অবতার। আর মায়ের প্রশ্রয়েই যত কুলাঙ্গার তৈরি হয়।
৫৯#
এই সেই আবহমানকালের পুরুষ যে স্ত্রীর কাছে কেবলই আশা করে বশ্যতা, মুগ্ধতা, নতশির দাসত্ব, প্রত্যুত্তরহীন অপমানের পাত্রী। এই সেই পুরুষ যারা আবলো। গুহামানবের উত্তরাধিকার এখনও রক্তে বহন করে। যারা শয্যাসঙ্গিনী ছাড়া স্ত্রীকে আর কিছুই।। অনেক ভাবতে পারে না। এদের চাই একটি সুন্দরী জ্যান্ত রক্তমাংসের পুতুল।
৬০#
কোনও কোনও পাগলামি হয়তো প্রতিভার লক্ষণ।
৬১#
আত্মহত্যা হচ্ছে জোয়ান বয়সের ব্যাপার। বুড়ো বয়সে আর ওসব করার মতো বুকের পাটা থাকে না। তখন লাথি ঝাঁটা খেয়েও প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় মানুষ।
৬২#
ভীতু আর দূর্বলদের একটা অসুবিধে কি জানো ? তারা ঊনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাদের দিয়ে যে যা খুশি করিয়ে নেয়।
৬৩#
মানুষের কোনও গন্তব্য নেই, শুধু গতি আছে। সে কোথায় চলেছে তা সে জানেই না।
৬৪#
নারীমুক্তি বলে কিছু নেই। প্রতি মুহূর্তেই পুরুষকে তার দরকার। কোনও মেয়ে যদি তার স্বামীকে না মানে, স্বাধীন হয়, তবে অন্য পুরুষরা তাকে ছিড়ে খাবে। স্বাধীন মেয়ের মতো এমন সহজ ভোগ্যবস্তু পুরুষের আর কী আছে? বড়ভোগ্যা হলে কি স্বাধীন হওয়া হয়?
৬৫#
সব মানুষই ভিতরে ভিতরে অল্পবিস্তর পাগল। পাগল ভিতরটাকে চেপে ঢেকে রেখেই মানুষকে চলতে হয়। যখন মানুষ নিজের ওপর বশ হারিয়ে ফেলে তখন বিড়বিড় করে, একা একা কথা কয়।
৬৬#
ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ায় রোমান্টিক প্রেম কবেই নির্বাসনে গেছে। আছে কেবল দগদগে যৌন সম্পর্ক। ওই সম্পর্কের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে মানুষ। বিয়ে করছে না, একসঙ্গে থাকছে, ছেলেপুলে হচ্ছে, বাঁধা পড়ছে না। পৃথিবীর ভবিতব্য কি তাহলে ওটাই? কুকুর বেড়ালের মতো শুধু দেহের প্রয়োজনে একসঙ্গে হওয়া এবং ফের আলাদা হয়ে যাওয়া, ইচ্ছে হলেই?
৬৭#
লোকে যখনই জীবনের সবচেয়ে সত্য বস্তুর সন্ধান পায় তখনই কি করে যেন লোকের চোখে পাগল বা ক্ষ্যাপা বলে মনে হয় লোকটিকে।
৬৮#
খিদের ব্যাপারটা থাকা ভাল, বুঝলি? খিদে মরে গেলে জীবনটা আলুনি হয়ে যায়।
৬৯#
গরিবের চরিত্র বলে কিছু থাকে না।
৭০#
মানুষের দাঁতে নখে জোর না থাক, তবু মানুষের চেয়ে হিংস্র আর কে আছে বল তো!
জীবন ও মৃত্যুর অর্থহীনতার মাঝখানে কী মহান এই পার্থিব জীবন! ক্ষণস্থায়ী, অথচ কত বর্ণময়।

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.