আহমদ ছফা একাধারে (৩০ জুন ১৯৪৩ – ২৮ জুলাই ২০০১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খান সহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফার লেখায় বিশেষ করে বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। আহমদ ছফা তার বিভিন্ন লেখা ও সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে অনেক রকম মন্তব্য করেছেন। ছফার সেইসব মন্তব্যের সংকলন তুলে ধরা হয়েছে এই লেখায়।
১
আওয়ামীলীগের যারা বুদ্ধিজীবী তাদের অনেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানসমাজে গ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলতে জানেন না। তাদের কথা অনেক সময় মনে হয় ভারতের তথাকথিত সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র। তাঁরা দেশের ভেতরে সেক্যুলারিজম আবিস্কার করতে অক্ষম। বাইরে থেকে সেক্যুলারিজম আমদানি করায় অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। এখানেই আমাদের জাতি এবং সমাজ জীবনের যাবতীয় বিপত্তির উৎস।
২
আওয়ামী লীগ যখন জিতে তখন শেখ হাসিনা তথা কিছু মুষ্টিমেয় নেতা জিতেন, আর আওয়ামী লীগ যখন হারে গোটা বাংলাদেশ পরাজিত হয়।
৩
জামাত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো বলে তাদের পলিটিক্স ব্যান করতে হবে এটায় আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু জামাতের মস্তবড় অপরাধ আমি মনে করি, তারা তাদের একাত্তরের ভূমিকাতে লজ্জিত নয়। আজকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধার জন্য জামাতকে সামনে নিয়ে এসে আওয়ামী লীগ একধরনের পলিটিক্যাল হারিকিরি করছে। সেটা আমাদের বেদনা। আমি বারবার বলেছি আওয়ামী লীগ যখন জিতে তখন শেখ হাসিনা তথা কিছু মুষ্টিমেয় নেতা জিতেন, আর আওয়ামী লীগ যখন হারে গোটা বাংলাদেশ পরাজিত হয়। আমি আওয়ামী লীগের নই, কিন্তু আওয়ামী লীগের পলিটিক্যাল কনটেন্ট আউটলিভ করার মত কোনো পলিটিক্স আমরা তৈরি করতে পারি নি। আওয়ামী লীগ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ভিন্ন রকম রাজনীতি সৃষ্টি করার চেষ্টা আমরা করেছি-করতে পারি নি।
৪
আওয়ামী লীগকে ইসলামের নামে ইলেকশান করে জিততে হবে। জামাতে ইসলামকে তো বটেই। এবং ইসলামের দাবিদার তো একজন নয়। কিন্তু আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছি তখন ইসলামের কথা না বলেও মুক্তিযুদ্ধ করতে পেরেছি। জনগণ আমাদের সাপোর্ট করেছে। তারপর আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যে প্রতিশ্র“তি, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তারা তো ভেঙেছে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ যারা করেছেন, তারা কী পরিমাণ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন সেই হিসাবটা তারা নিজেরাও করে দেখেন না। এবং আরো একটা প্রচ- জিনিস, জনগণের দাবি এবং জনগণের প্রয়োজন এটার বদলে দুটি কথা ক্রমাগত সকলে বলে, প্রথমটি ইসলাম; আরেকটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ।
৫
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগ যদি সরাসরি গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতো তাহলে তারা জনগণের ভেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পার্লামেন্টে চলে আসতে পারতো। তাদেরকে কে বুদ্ধি দিলো যে কেয়ারটেকার গভমেন্ট করতে! আইডিয়াটা জামাতের। আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের আন্দোলনে গেছে কিন্তু নিজের রাজনীতিটাকে বিকশিত করার জন্য কোনো কিছু করে নি। পলিটিক্যালি তার ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি। এবং দেশের মধ্যে একমাত্র পলিটিক্যাল পার্টি আওয়ামী লীগ। আমাদের একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া থেকে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে। এবং আওয়ামী লীগ যদি টোটালি পলিটিক্যালি বিহেভ করতো অন্য পার্টিগুলো পলিটিক্যালি বিহেভ করতে বাধ্য হতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন একটা পজিশানে পড়েছে তার ডান পাশে জামাত বাঁ পাশে জাতীয় পার্টি। এ দুটি পার্টি রাইটিস্ট। জামাত হচ্ছে এক্সট্রিম রাইটিস্ট, জাতীয় পার্টি হচ্ছে সেন্ট্রিস্ট রাইটিস্ট। এবং বিএনপি তো রাইটিস্ট পার্টিই। এখন দেশের পলিটিক্সটাকে সার্বিকভাবে একটি সাম্প্রদায়িক খাতে তারা নিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের ভুলের জন্যে সাম্প্রদায়িক খাতে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের একটি জাতীয় চরিত্র ছিলো। একটি গণতান্ত্রিক চরিত্র ছিলো। একটা ফ্যাসীবাদী চরিত্র ছিলো। এবং তার একটি ইসলামী পরিচয়ও ছিলো। জামাত এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে চলতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে দেখাতে হচ্ছে সে ইসলাম মানে। এবং এগুলো করতে গিয়ে রাজনীতির যে খাতটা ছিলো একেবারে রাইটিস্ট কোটে চলে গেছে। এ কথাটি কেউ বলছে না। এটা খুব বেদনার কথা।
৬
আওয়ামী মুসলীম লীগের সকল নেতৃবৃন্দ এককালে ছিলেন পাকিস্তানি। আমার শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক সেদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, তার কাছে শেখ মুজিবের কিছু ছবি আছে, সেই ছবিতে জিন্নাহ মারা যাওয়ার পর শেখ মুজিব হাউমাউ করে কাঁদছেন।
৭
শেখ মুজিবের প্রতি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিকদের একটা সন্দেহ ছিল। শেখ মুজিব গোড়া থেকে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা এবং আমি আগেই বলছি, তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি ছিলেন পশ্চিমা ব্লকের লোক।
৮
মুসলিম লীগের রাজনীতিতে শেখ মুজিব ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য এবং গুরু শিষ্য দু’জনেই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। বাংলাদেশ যারা স্বাধীন করেছেন এক সময় তাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম লীগে। মুসলিম লীগের Extension or junior partner।