হিমু একটি ফিকশন চরিত্র। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর সবচেয়ে জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র। হিমু মূলত একজন বেকার যুবক ; যার আচরণে বেখেয়ালী, জীবনযাপনে ছন্নছাড়া ও বৈষয়িক ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ভাব প্রকাশ পায়। চাকরির সুযোগ থাকলেও সে চাকরি কখনো করে না বলেই সে বেকার। তার অস্বাভাবিক চরিত্রের মধ্যে সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তাঘাটে দিন-রাত ঘুরে বেড়ায় এবং মাঝে মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী করে মানুষকে চমকে দেয়। হিমুর প্রেমিকার নাম রূপা। রূপাকে সে ভালোবাসে একইসাথে সে উদাসীন। হিমু সিরিজের প্রথম উপন্যাস ময়ূরাক্ষী নামে প্রকাশিত হয়। প্রাথমিক সাফল্যের পর হিমু চরিত্র বিচ্ছিন্নভাবে হুমায়ুন আহমেদের বিভিন্ন উপন্যাসে প্রকাশিত হতে থাকে। হিমু সিরিজে হুমায়ূন আহমেদ মোট ২১ টি বই লিখেছিলেন হিমুকে নিয়ে। হিমুর রূপা সম্পর্কে করা কথাগুলোর বেশ কয়েকটি অংশ তুলেছি এই ব্লগ পোস্টে।
১
আমি জানি রূপা আমার কথা বিশ্বাস করে না, তবু যত্ন করে শাড়ি পরে। চুল বাঁধে। চোখে কাজলের ছোঁয়া লাগিয়ে কার্নিশ ধরে দাঁড়ায়। সে অপেক্ষা করে। আমি কখনো যাই না। আমাকে তো আর দশটা সাধারণ ছেলের মতো হলে চলবে না। আমাকে হতে হবে অসাধরণ। আমি সারাদিন হাঁটি। আমার পথ শেষ হয় না। গন্তব্যহীন যে যাত্রা তার কোনো শেষ থাকার তো কথাও নয়।
২
আমি কখনো রূপাকে চিঠি লিখি নি। একবার হঠাৎ একটি চিঠি লিখতে ইচ্ছা হলো। লিখতে বসে দেখি কী লিখব ভেবে পাচ্ছি না। অনেকবার করে একটি লাইন লিখলাম: রূপা তুমি কেমন আছ? সমস্ত পাতা জুড়ে একটি মাত্র বাক্য। সেই চিঠির উত্তর রূপা খুব রাগ করে করে লিখল: তুমি এত পাগল কেন? এতদিন পর একটা চিঠি লিখলে, তারমধ্যেও পাগলামি । কেন এমন কর? তুমি কি ভাবো এইসব পাগলামি দেখে আমি তোমাকে আরো বেশি ভালোবাসব?
—হুমায়ূন আহমেদ (ময়ুরাক্ষী)
৩
হিমু-রূপার অসম প্রেমের গল্প হয়তো আমরা সবাই জানি। রূপা হিমুকে পেতে চায়। কিন্তু বাউণ্ডুলে হিমু বরাবরই রূপার প্রেম নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে মহাপুরুষ হবার আশায়।
হুমায়ূন আহমেদ (“ময়ূরাক্ষী”)
৪
:হ্যালো রুপা , আমি হিমু ।
:বুঝতে পারছি।
:কেমন আছো রুপা ?
: আমি কেমন আছি সেটা জানার জন্য তুমি আমাকে টেলিফোন করোনি । তোমার অন্য উদ্যেশ্য আছে । বলে ফেলো ।
: রাগ করছো কেন ?
: রাগ করছি না । তোমার উপর রাগ করা অর্থহীন। যে রাগ বোঝে না তার উপর রাগ করে লাভ কি ?
: রাগ হচ্ছে মানব চরিত্রের অন্ধকার বিষয়ের একটি । রাগ না বোঝাটা তো ভালো ।
: যে অন্ধকার বোঝে না সে আলোও ধরতে পারে না ।
: রুপা তোমার লজিকের কাছে সারেন্ডার করছি ।
~এবং হিমু, হুমায়ূন আহমেদ
৫
রুপা কে আমি দেখিনি, তার ছবি দেখেছি,কী মিষ্টি কী শান্ত চেহারা। পটে আঁকা ছবি। রূপা যেনো হারিয়ে না যায় তার জন্যেই হিমুর বান্ধবী হিসেবে আমি তাকে নিয়ে আসি। হিমু কে নিয়ে লেখা প্রতিটি উপন্যাসে রূপা আছে। আমরা কাউকে হারাতে চাই না, কিন্তু সবাইকেই হারাতে হয়।
~ হুমায়ূন আহমেদ (মাতাল হাওয়া)
৬
রুপা: তুমি কি জানো আমি তোমার কথা খুব ভাবি!
হিমু:আমি জানি!
রুপা:সত্যি জানো?
হিমু:হ্যা জানি,
রুপা : কি করে জানো?
হিমু : ভালোবাসা টের পাওয়া যায়!
রুপা : এর নাম কি ভালোবাসা?
হিমু : আমার জানা নেই রুপা
রুপা : তুমি কি আসবে আমাদের বাসায়?
হিমু : আসব
রুপা : কখন আসবে?
হিমু : এক্ষুনি আসছি।
রুপা : তুমি কি সকালে আসতে পার না?
হিমু : না রুপা,আমাকে এক্ষুনি আসতে হবে।
রুপা :আচ্ছা বেশ আসো।
হিমু : তোমার কি কোনো নীল রঙের শাড়ি আছে?
রুপা: কেন বলতো?
হিমু : যদি থাকে তাহলে নীল রঙের শাড়ি পরে গেটের কাছে থাকো, আমি এলেই গেট খুলে দেবে
রুপা :আচ্ছা!
আমি গেলাম না, আবারো মাস খানিকের জন্য ডু’ব দিলাম, কারণ ভালোবাসার মানুষদের খুব কাছে কখনো যেতে নেই!!
~ ময়ূরাক্ষী, হুমায়ূন আহমেদ
৭
আমার সমস্যার কথা রুপাকে কি আমি বলতে পারি? আমি কি বলতে পারি – আমার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্য সারাদিন আমি পথে পথে ঘুরি। মহাপুরুষ হবার সাধনা করি. যখন খুব ক্লান্তি অনভব করি তখন একটি নদীর স্বপ্ন দেখি। যে নদীর জল ছুয়ে ছুয়ে এক জন তরুনি ছুটে চলে যায়. এক বার শুধু থমকে দাড়িয়ে তাকায় আমার দিকে। তার চোখে গভীর মায়া ও গাঢ় বিষাদ। এই তরুনীটি আমার মা. আমার বাবা যাকে হত্যা করেছিলেন।
এই সব কথা রুপাকে বলার কোনো অর্থ হয় না. বরং কোনো-কোনো দিন তরঙ্গিনী স্টোর থেকে টেলিফোন করে বলি – রুপা, তুমি কি এক্ষুনি নীল রঙের একটা সারি পরে তোমাদের ছাদে উঠে কার্নিশ ধরে নিচের দিকে তাকাবে? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। একটুখানি দাড়াও। আমি তোমাদের বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে হেটে চলে যাব.
আমি জানি রুপা আমার কথা বিশাস করে না, তবুও যত্ন করে সারি পরে. চুল বাধে। চোখে কাজলের ছোয়া লাগিয়ে কার্নিশ ধরে দাড়ায়। সে অপেক্ষা করে. আমি কখনো যাই না.
আমাকে তো আর দশটা ছেলের মত হলে চলবে না. আমাকে হতে হবে অসাধরণ।আমি সারাদিন হাটি। আমার পথ শেষ হয় না. গন্তব্যহীন যে যাত্রা তার কোনো শেষ থাকার তো কথাও নয়.
~ হুমায়ূন আহমেদ, ময়ূরাক্ষী
৮
মজিদ বোধহয় রিকশা ঠিক করে ফেলেছে। তবে ঠিক করলেও সে আমাকে বলবে না । অপেক্ষা করবে। এর মধ্যেই অতি দ্রুত রূপার সঙ্গে একটা কথা সেরে নেয়া দরকার ।
আমি টেলিফোন করতেই রূপার বাবা ধরলেন । আমি গম্ভীর গলায় বললাম, এটা কি রেলওয়ে বুকিং?
তিনি ক্ষিপ্ত গলায় বলেলন, ফাজিল ছোকরা , হু আর ইউ? কী চাও তুমি?
রূপাকে দেবেন?
রাসকেল, ফাজলামি করার জায়গা পাও না । আমি তোমাকে এমন শিক্ষা দেব।
আপনি এত রেগে গেছেন কেন?
শাট আপ ।
আমি ভদ্রলোককে আরো খানিকক্ষণ হইচই করার সুযোগ দিলাম। আমি জানি হইচই শুনে রূপা এসে টেলিফোন ধরবে। হলোও তাই , রূপার গলা শোনা গেল- । সে করুণ গলায় বলল, তুমি চলে এস।
কখন?
এই এখন । আমি বারান্দায় দাড়িয়ে থাকব।
আচ্ছা আসছি।
অনেকবার আসছি বলেও তুমি আস নি- এইবার যদি না আস তাহলে ….
তাহলে কী?
রূপা খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল,আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকব।
রূপার বাবা সম্ভবত তার হাত থেকে টেলিফোনটা কেড়ে নিলেন। খট করে রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো । আজ ওদের বাড়িতে ভূমিকম্প হয়ে যাবে। রূপার বাবা,মা,ভাই-বোন কেউ আমাকে সহ্য করতে পারে না । রূপার বাবা তাঁর দারোয়ানকে বলে রেখেছেন কিছুতেই যেন আমাকে ঐ বাড়িতে ঢুকতে না দেয়া হয়। আজ কী হবে কে জানে?
~ ময়ূরাক্ষী, হুমায়ূন আহমেদ
