গোরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উপন্যাস। এটি ১৮৮০-এর দশকে ব্রিটিশ রাজত্বকালের সময়কার কলকাতার পটভূমিতে লেখা। এটি লেখার ক্রমে পঞ্চম এবং রবীন্দ্রনাথের তেরোটি উপন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘতম। এটি রাজনীতি এবং ধর্ম নিয়ে দার্শনিক বিতর্কে সমৃদ্ধ উপন্যাস।
উপন্যাসে মুক্তি, সর্বজনীনতা, ভ্রাতৃত্ব, লিঙ্গ, নারীবাদ, বর্ণ, শ্রেণি, ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা, নগর অভিজাত বনাম গ্রামীণ কৃষক, ঔপনিবেশিক শাসন, জাতীয়তাবাদ এবং ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে লেখা রয়েছে।উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে চোখে পরে – গোরা।
১#
পৃথিবীতে যারা মুখ ফুটে নালিশ করতে পারে না, চুপ করে থাকে, তারাই উলটে আসামি হয়।
২#
যিনি ভক্তির পাত্র তাঁকে ভক্তি করবার মতো ক্ষমতা যদি না থাকে অন্তত তাঁকে উপহাস করবার ক্ষুদ্রতা থেকে নিজেকে রক্ষা কোরো।
৩#
আপন যখন পর হয় তখন তাঁকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই।
৪#
যে লক্ষ্মী আমাদের গৃহকে পুণ্যে সৌন্দর্য ও প্রেমে মধুর ও পবিত্র করেন, আমাদের শিশুকে মানুষ করেন, রোগীকে সেবা করেন, তাপীতকে সান্ত্বনা দেন, তুচ্ছকে প্রেমের গৌরবে প্রতিষ্ঠা দান করেন, দুঃখ দুর্গতিতে আমাদের ত্যাগ করেন না, অবজ্ঞা করেন না….. এই লক্ষ্মীর দিকেই আমরা তাকাই নাই, ইহাকেই আমরা সকলের পিছনে ঠেলিয়া রাখিয়াছি। আমাদের এমন দুর্গতির লক্ষণ আর কিছুই নাই।
৫#
হাঁ, লোভী লোকের এইরকম দশাই ঘটে। উপস্থিতের প্রলোভনে ভবিষ্যৎ খুইয়ে বসে।
৬#
গোরা বলেন, গভীর শ্রদ্ধাই আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় সকলের চেয়ে বড়ো পথ্য- এই শ্রদ্ধার অভাবেই আমরা দেশকে সমগ্রভাবে জানতে পারছি নে- জানতে পারছি নে বলেই তার সম্বন্ধে যা ব্যবস্থা করছি তা কুব্যবস্থা হয়ে উঠছে। দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানবার ধৈর্য থাকে না, তাকে না জানলে তার ভালো করতে চাইলেও তার ভালো করা যায় না।
৭#
আমি তো পূর্বেই বলেছি অজ্ঞানী সকল দেশেই সকল সত্যকেই বিকৃত করবে।
৮#
কাঁটা কোথায় আছে তাহা জানিতে পারিলে তবে কাঁটা তুলিয়া ফেলিতে পারা যায়।
৯#
দয়াবৃত্তিই কি ভালো-মন্দ-সুবিচারের ক্ষমতাকে বিকৃত করিয়া দেয় না? দয়া করিবার ঝোঁকটা আমাদের যতই বাড়িয়া উঠে নির্বিকারভাবে সত্যকে দেখিবার শক্তি আমাদের ততই চলিয়া যায়–প্রধূমিত করুণার কালিমা মাখাইয়া যাহা নিতান্ত ফিকা তাহাকে অত্যন্ত গাঢ় করিয়া দেখি।
১০#
সত্যকে যখন পাই তখন সে তার সমস্ত অভাব-অপূর্ণতা নিয়েও আমাদের আত্মাকে তৃপ্ত করে- তাকে মিথ্যা উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে তোলবার ইচ্ছামাত্রই হয় না।
১১#
মিথ্যা পাপ, মিথ্যা নিন্দা আরো পাপ, এবং স্বজাতির মিথ্যা নিন্দার মতো পাপ অল্পই আছে।
১২#
আমাদের ইচ্ছা যদি অন্যায় ইচ্ছা না হয় এবং সে ইচ্ছা যদি কোনো-একটা সমাজের নিয়মের সঙ্গে আগাগোড়া না মিলে যায় তা হলেই আমাদের মাথা হেঁট করে ফিরে যেতে হবে এ আমি কোনোমতেই বুঝতে পাড়ি নে । সমাজে মিথ্যা ব্যাবহারের স্থান আছে আর স্থান নেই ন্যায় আচরনের ?
১৩#
জিনিসটিও রাখিব মূল্যটিও দিব না’ এমন চতুরতা পৃথিবীতে খাটে না। একটা-কিছু বাছিয়া লইতে গেলেই অন্যটাকে ত্যাগ করিতেই হয়।
১৪#
এই জ্ঞানটি সে পাইয়াছিল যে, যাহা নিজে বুঝিয়াছি তাহাকে পূর্ণভাবে বলিলে তবেই ছেলেবুড়া সফলে আপন আপন শক্তি-অনুসারে তাহাকে একরকম বুঝিতে পারে, তাহাকে অন্যের বুদ্ধির উপযোগী করিয়া হাতে রাখিয়া বুঝাইতে গেলেই সত্য আপনি বিকৃত হইয়া যায়।
১৫#
চিঠি বড়ো একটা রহস্যময় পদার্থ। বাহিরে কেবল নামটুকু দেখাইয়া সব কথাই সে ভিতরে রাখিয়া দেয় বলিয়া সে মানুষকে নিতান্ত অকারণে নাকাল করিতে পারে।
১৬#
ছোট ছেলেকে বুকে তুলে নিলেই বুঝতে পারা যায় যে, জাত নিয়ে পৃথিবীতে কেউ জন্মায় না।
১৭#
পৃথিবীতে যাহারা সাহস করিয়া নিজের জীবনের দ্বারা নব নব সমস্যার মীমাংসা করিতে প্রস্তুত হয় তাহারাই সমাজকে বড়ো করিয়া তুলে। যাহারা কেবলই বিধি মানিয়া চলে তাহারা সমাজকে বহন করে, মাত্র তাহাকে অগ্রসর করে না।
১৮#
একটা বিশেষ প্রকৃতি, বিশেষ শক্তি, বিশেষ সত্য আছে, সেইটের পরিপূর্ণ বিকাশের দ্বারাই ভারত সার্থক হবে, ভারত রক্ষা পাবে।
১৯#
যিনি ভক্তির পাত্র, তাঁকে ভক্তি করবার মতো ক্ষমতা যদি না থাকে, অন্তত তাঁকে উপহাস করবার ক্ষুদ্রতা থেকে, নিজেকে রক্ষা কোরো।
২০#
সকল মানুষের ভিতরকার ভালোটি বিনয়বাবু দেখতে পান এইজন্যই সকল মানুষের যেটুকু ভালো সেটুকু ওঁর ভোগে আসে। সে অনেকটা ওঁর গুণ।
২১#
যে আশ্রয় জীর্ণ তাহাকে যতই জোরের সঙ্গে আঁকড়িয়া ধরা যায় তাহা ততই ভাঙিতে থাকে।
২২#
মানুষকেই সমাজের খাতিরে সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে এ কথা কখনোই ঠিক নয় সমাজকেই মানুষের খাতিরে নিজেকে কেবলই প্রশস্ত করে তুলতে হবে। সেজন্যে যারা দুঃখ স্বীকার করতে রাজি আছে আমি তো তাদের নিন্দা করতে পারব না।
২৩#
আজ বুঝেছি মানুষের জীবনের গতি মহানদীর মতো। সে আপনার বেগে অভাবনীয় রূপে এমন নূতন নূতন দিকেপথ করে নেয় যেদিকে পূর্বে তার স্রোত ছিল না। এই তার গতির বৈচিত্র্য। তার অভাবনীয় পরিণতি বিধাতার অভিপ্রায়। সে কাটা খাল নয় তাকে বাঁধা পথে রাখা চলবে না।
২৪#
আমার সাত পুরুষের সংস্কার একটা একটা করে নির্মূল করা হয়েছে– সে কি এখন আর বললেই ফেরে?
২৫#
একজনের সমাদরের দ্বারা অন্য সকলের অনাদরটা যেখানে বেশি করে ফুটে ওঠে সেখানে এরকম সমাদরকে আমি অপমান বলে গণ্য করি।
২৬#
সমস্ত আঘাত নিজের উপর লইয়া ইহাকে বাচাইতে হইবে।। এতো বড়ো তেজ পরাভূত হইয়া ফিরিয়া যাইবে সেও যেমন-অসহ্য জয়ী হইবার দুর্গম উৎসাহে এ যে মৃত্যুবান বুক পাতিয়া লইবে। সেও তেমনি নিদারুণ। ইহাকে জয়ীও করিতে হইবে, ইহাকে রক্ষাও করিতে হইবে।
২৭#
চুপ করে না থেকে চঞ্চল হয়ে উঠলে জালে আরো বেশি করে গ্রন্থী পড়ে। কিছু একটা করাকেই যে কর্তব্য বলে, তা নয় অনেকসময় কিছু না করাই হচ্ছে সকলের চেয়ে বড়ো কর্তব্য।
২৮#
পৃথিবীতে যাহারা নিজের জীবনের পথ জোরের সঙ্গে
বাছিয়া লইতে পারিয়াছে তাহারাই নিশ্চিন্ত হইয়াছে।
যে হতভাগা এ পথও ভালোবাসে ও পথও ভালোবাসে,
কোনোটা হইতেই নিজেকে বঞ্চিত করিতে পারে না,
সে গম্যস্থান হইতেই বঞ্চিত হয়।
২৯#
সমস্ত উদ্বেগ নিস্তব্ধ ভাবে পরিপাক করাই তাঁহার চিরদিনের অভ্যাস। সুখ ও দুঃখ উভয়কেই তিনি শান্ত ভাবে গ্রহণ করিতেন। তাঁহার হৃদয়ের আক্ষেপ কেবল অন্তর্যামীরই গোচর ছিল।
৩০#
এক পেয়ালা চা খেলে সমস্ত দেশকে যদি আঘাত করা হয় তবে সে আঘাতে দেশের উপকার হবে।
৩১#
মুখের তর্কে একটা জিনিষকে একরকম করে দেখানো যেতে পারে কিন্তু কাজে সেরকমটি পাওয়া যায় না। নইলে কেউ ইচ্ছে করে কি পুরাতন সমাজকে ছাড়তে পারে, যে সমাজ মানুষের ধর্মবোধকে বাহ্য আচারের বেড়ি দিয়ে একই জায়গায় বন্দী করে বসিয়ে রাখতে চায় তাকে মানতে গেলে নিজেদের চিরদিনের মতো কাঠের পুতুল করে রাখতে হয়।
৩২#
পৃথিবীতে সফলতার চেহারা দেখতে পাওয়া বড়ো শক্ত। গ্রীসের সফলতা আজ গ্রীসের মধ্যে নেই, সেজন্যে বলতে পারি নে গ্রীসের সমস্ত আইডিয়াই ভ্রান্ত এবং ব্যর্থ। গ্রীসের আইডিয়া এখনো মানবসমাজের মধ্যে নানা আকারে সফলতা লাভ করছে।
৩৩#
বিধাতা কোনো কোনো মানুষকে সহজেই বেশি ভারগ্রস্ত করে গড়ে থাকেন, কেউ বা সহজেই দিব্য ভারহীন– এই উভয় জীবকে একত্রে জুড়ে চালাতে গেলে এদের একটির উপর বাইরে থেকে বোঝা চাপিয়ে দুজনের ওজন সমান করে নিতে হয়।
৩৪#
“অহংকার জিনিসটা হাতি-ঘোড়ার মতো নয় ; তাহাকে নিতান্তই অলপ খরচে ও বিনা খোরাকে বেশ মোটা করিয়া রাখা যায়।”
_ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩৫#
নীচতার আক্রমণ থেকে, অসত্যের দাসত্ব থেকে মুক্তিকেই আমি মুক্তি বলি।
৩৬#
পরের কাঁধে ভর দিয়ে নিজের লোকদের নিচু করে দেখব এবং নিচু করে দেখবামাত্রই তাদের প্রতি অবিচার করতে বাধ্য হব, এতে কোনো মঙ্গল হতে পারে না।
৩৭#
সত্যের পরীক্ষা যে কোনো এক প্রাচীনকালে এক দল মনীষীর কাছে একবার হয়ে গিয়ে চিরকালের মতো চুকেবুকে যায় তা নয়, প্রত্যেক কালের লোকের কাছেই বাধার ভিতর দিয়ে, আঘাতের ভিতর দিয়ে, সত্যকে নূতন করে আবিষ্কৃত হতে হবে।
৩৮#
আসক্তির ছিদ্র দিয়ে দুর্বলতা যে মানুষকে কিরকম দুর্নিবারভাবে আক্রমণ করে তা অনেক দেখেছি এবং মানুষের দুর্বলতাকে যে কিরকম করে ক্ষমা করতে হয় তাও আমি জানি, কিন্তু যে দুর্বলতা কেবল নিজের জীবনকে নয়, শতসহস্র লোকের জীবনের আশ্রয়কে একেবারে ভিত্তিতে গিয়ে আঘাত করে, তুমিই বলো, ললিতা, তাকে কি এক মুহূর্তের জন্য ক্ষমা করা যায়? তাকে ক্ষমা করবার অধিকার কি ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন?
৩৯#
মতকে মত দিয়ে যুক্তিকে যুক্তি দিয়ে বাঁধা দেয়া চলে , কিন্তু বুদ্ধির বিষয়কে ক্রোধ দিয়ে দণ্ড দেয়া বর্বরতা ।
৪০#
আপন যখন পর হয়, তখন তাঁকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই।
৪১#
আমার উপরে সত্য নির্ভর করছে , সত্যের উপরে আমি নির্ভর করছি নে’ এরকম যাদের ধারণা তাদেরই বলে গোঁড়া ।
৪২#
দু নৌকায় পা দেওয়া যার স্বভাব আমার নৌকা থেকে তাকে পা সরাতে হবে এতে আমারই কষ্ট হোক, তারই কষ্ট হোক।
৪৩#
যাহার কিছু বলিবার নাই করিবার নাই, ভাবিয়া যাহার কিনারা পাওয়া যায় না,কাঁদিয়া যাহার অন্ত হয় না, সেই দুঃখ যে কী দুঃখ……!
৪৪#
দুঃখের সান্ত্বনা যে ঈশ্বর কোথায়, কত জায়গায় রেখেছেন, তা সব সময় জানতে পারিনে বলেই আমরা কষ্ট পাই।
৪৫#
অবজ্ঞা ও অহংকার দূর করে নম্র হয়ে ভালোবেসে নিজেকে অন্তরের সঙ্গে সকলের করুন, সেই ভালোবাসার কাছে সহস্র ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা সহজেই হার মানবে।
৪৬#
বিধাতা যেখানে অধিকার বেশি দিয়াছেন
সেইখানেই দুঃখ এবং পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন
করিয়াছেন।
৪৭#
গোরা কহিল,” মা,তুমিই আমার মা।যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসে ছিলেন। তোমার জাত নেই,বিচার নেই,ঘৃণা নেই- শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা।
৪৮#
নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়।
৪৯#
প্রশ্নটা ঠিকমত মনে জেগে ওঠবার পূর্বেই সে সম্বন্ধে কোনো উপদেশ দিতে যাওয়া আর ক্ষুধা পাবার পূর্বেই খাবার খেতে দেওয়া একই, তাতে কেবল অরুচি এবং অপাক হয়।
৫০#
আমাদের ইচ্ছা যদি অন্যায় ইচ্ছা না হয় এবং সে ইচ্ছা যদি কোনো-একটা সমাজের নিয়মের সঙ্গে আগাগোড়া না মিলে যায় তা হলেই আমাদের মাথা হেঁট করে ফিরে যেতে হবে এ আমি কোনোমতেই বুঝতে পাড়ি নে । সমাজে মিথ্যা ব্যাবহারের স্থান আছে আর স্থান নেই ন্যায় আচরনের ?
৫১#
জাহাজের কাপ্তেন যখন সমুদ্রে পাড়ি দেয় তখন যেমন আহারে বিহারে কাজে বিশ্রামে সমুদ্রপারের বন্দরটিকে সে মনের মধ্যে রেখে দেয় আমার ভারতবর্ষকে আমি তেমনি করে মনে রেখেছি।

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.