কৃষ্ণকান্তের উইল বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি বাংলা উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৮৭৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। রোহিনী, ভ্রমর এবং গোবিন্দলালের ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী বর্নিত হয়েছে কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে। উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র রোহিনী তাকে নিয়ে কাহিনীর ঘনঘটা ৷
কৃষ্ণকান্ত তার উইলে নিজের নষ্ট ছেলেকে বাদ দিয়ে ভাতিজা গোবিন্দলালকে সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে যাবার কাহিনী থেকে এ উপন্যাসের নাম করণ কৃষ্ণকান্তের উইল রেখেছিলেন হয়ত ৷
রোহিনীর সহায়তা নিয়ে কৃষ্ণকান্তের বড় ছেলে উইল পরিবর্তনের চেষ্টা করে সেটা জানার পর কৃষ্ণকান্তের শাস্তি থেকে রক্ষ করে গোবিন্দলাল৷ সহধর্মিনী ভ্রমরের ভালবাসাকে উপেক্ষা করে গোবিন্দলাল প্রেমে পড়ে বিধবা রোহিনীর রূপের। ভ্রমর অসহায় নীরিহ এক নারীর প্রতীক হয়ে উঠেছে এখানে ৷
ভাগ্যের পালাবদল লক্ষ্য করাই যেন তার কাজ ৷
রোহিনী গোবিন্দলালকে ভালোবেসেছিল। কাজেই সে খারাপ পথে অর্থাৎ ভ্রমরকে কিছু নকল গয়না দেখিয়ে বলেছিল এগুলো গোবিন্দলাল তাকে দিয়েছে। যাতে ভুল বোঝাবুঝিতে সংসার বিনষ্ট হলে সে প্রবেশ করতে পারে ৷
রোহিনী পারেনা এমন কাজ নাই,তাকে অনেক ভাবে লেখক দেখিয়েছে পাঠককে ৷ দুই নারীর মৃত্যু এবং তার জীবন সব মিলিয়ে একটি বিরহ-অবস্থর সৃষ্টি করেছে উপন্যাসের শেষ-অংশে ৷ অনেক পথ পেরিয়ে গোবিন্দলাল বুঝতে পারে রূপের মোহ মরিচীকা
১
ক্ষত ভালো হয়ে যায়, দাগ হয় না।
২
তুমি, বসন্তের কোকিল! প্রাণ ভরিয়া ডাক, তাহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই, কিন্তু তোমার প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ যে, সময় বুঝিয়া ডাকিবে। সময়ে অসময়ে, সকল সময়ে ডাকাডাকি ভাল নহে।
৩
যাহাকে ভালবাস, তাহাকে নয়নের আড় করিও না। যদি প্রেমবন্ধান দৃঢ় রাখিবে, তবে সূতা ছোট করিও। বাঞিতকে চোখে চোখে রাখিও। অদর্শনে কত বিষময় ফল ফলে। যাহাকে বিদায় দিবার সময়ে কত কাঁদিয়াছ, মনে করিয়াছ, বুঝি তাহাকে ছাড়িয়া দিন কাটিবে না,_-কয় বসর পরে তাহার সহিত আবার যখন দেখা হইয়াছে, তখন কেবল জিজ্ঞাসা করিয়াছ-“ভাল আছ ত?
৪
এখন তিনিই আমার সম্পত্তি-তিনিই আমার ভ্রমর-ভ্রমরাধিক ভ্রমর।
৫
আমি পাপপুণ্য জানি না —আমাকে কেহ শিখায় নাই। আমি পাপপুণ্য মানি না— কোন পাপে আমার এই দণ্ড? পাপ না করিয়াও যদি এই দুঃখ তবে পাপ করিলেই বা ইহার বেশী কি হইবে?
৬
আমি সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত সংসারপতঙ্গ
৭
হে জগদীশ্বর, হে দীননাথ, হে দুঃখিজনের একমাত্র সহায়! আমি নিতান্ত দুঃখিনী, নিতান্ত দুঃখে পড়িয়াছি—আমায় রক্ষা কর—আমার হৃদয়ে এই অসহ্য প্রেমবহ্নি নিবাইয়া দাও—আর আমায় পোড়াইও না। আমি যাহাকে দেখিতে যাইতেছি—তাহাকে যতবার দেখিব, ততবার—আমার অসহ্য যন্ত্রণা-অনন্ত সুখ। আমি বিধবা-আমার ধর্ম গেল—সুখ গেল—প্রাণ গেল—রহিল কি প্রভু!—হে দেবতা! হে দুর্গা! হে কালি—হে জগন্নাথ—আমায় সুমতি দাও—আমার প্রাণ স্থির কর—আমি এই যন্ত্রণা আর সহিতে পারি না ।
৮
পুরুষ অহংকারে পরিপূর্ণ
৯
কি অপরাধে এ বালবৈধব্য আমার অদৃষ্টে ঘটিল? আমি অন্যের অপেক্ষা এমন কি গুরুত্বর অপরাধ করিয়াছি যে, আমি এ পৃথিবীর কোন সুখ ভোগ করিতে পাইলাম না। কোন্ দোষে আমাকে এরূপ যৌবন থাকিতে কেবল শুষ্ক কাঠের মত এ জীবন কাটাইতে হইল । যাহারা এই পৃথিবীতে সকল সুখে সুখী — মনে করে, ঐ গোবিন্দলাল বাবুর স্ত্রী—তাহারা আমার অপেক্ষা কোন গুণে গুণবতী – কোন পুণ্যফলে তাহাদের কপালে এ সুখ—আমার কপালে শূন্য……আমার সকল পথ বন্ধ কেন?
১০
রাত্রিদিন দারুণ তৃষায় হৃদয় পুড়িতেছে—সম্মুখ শীতল জল, কিন্তু ইহজন্মের সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না। আশাও নাই।
১১
কত লোকে যে মনে মনে মৃত্যুকামনা করে, কে তাহার সংখ্যা রাখে? আমার বোধ হয়, যাহারা সুখী, যাহারা দুঃখী তাহাদের মধ্যে অনেকেই কায়মনোবাক্যে মৃত্যুকামনা করে। এ পৃথিবীর সুখ সুখ নহে, সুখও দুঃখময়, কোন সুখেই সুখ নাই, কোন সুখই সম্পূর্ণ নহে, এই জন্য অনেক সুখী জনে মৃত্যুকামনা করে–আর দুঃখী দুঃখের ভার আর বহিতে পারে না বলিয়া মৃত্যুকে ডাকে।
মৃত্যুকে ডাকে, কিন্তু কার কাছে মৃত্যু আসে? ডাকিলে মৃত্যু আসে না। যে সুখী, যে মরিতে চায় না, যে সুন্দর, যে যুবা, যে আশাপূর্ণ, যাহার চক্ষে পৃথিবী নন্দনকানন, মৃত্যু তাহারই কাছে আসে।
১২
যা যায় তা আর আসেনা। যা ভাঙ্গে,আর তা গড়েনা।
১৩
গোবিন্দলাল তাহা পারিল না। কতকটা অহঙ্কার–পুরুষ অহঙ্কারে পরিপূর্ণ। কতকটা লজ্জা–দুষ্কৃতকারীর লজ্জাই দণ্ড। কতকটা ভয়–পাপ, সহজে পুণ্যের সম্মুখীন হইতে পারে না। ভ্রমরের কাছে আর মুখ দেখাইবার পথ নাই। গোবিন্দলাল আর অগ্রসর হইতে পারিল না। তাহার পর গোবিন্দলাল হত্যাকারী। তখন গোবিন্দলালের আশা ভরসা ফুরাইল। অন্ধকার আলোকের সম্মুখীন হইল না।
১৪
মরিবে কেন? মরিও না। আমাকে হারাইয়াছ, তাই মরিবে? আমার অপেক্ষাও প্রিয় কেহ আছেন। বাচিলে তাহাকে পাইবে
১৪
সুমতি নামে দেবকন্যা এবং কুমতি নামে রাক্ষসী এই দুইজন সর্বদা মানুষ্যের হৃদয়ক্ষেত্রে বিচরণ করে ; এবং সর্বদা পরষ্পরের সহিত যুদ্ধ করে। যেমন দুইটা বাঘ্রী মৃত গাভী লইয়া পরষ্পরে যুদ্ধ করে, যেমন দুই শৃগাল মৃত নরদেহ লইয়া বিবাদ করে, ইহারা জীবন্ত মানুষ্য লইয়া সেইরূপ করে।
১৫
যাহাকে ভালবাসো, তাহাকে নয়নের আড় করিও না। যদি প্রেমবন্ধন দৃঢ় রাখিবে, তবে সূতা ছোট করিও । বাঞ্ছিতকে চোখে চোখে রাখিও, অদর্শনে কত বিষময় ফল ফলে । যাহাকে বিদায় দিবার সময়ে কত কাঁদিয়াছ, মনে করিয়াছ, বুঝি তাহাকে ছাড়িয়া দিন কাটিবে না—কয় বৎসর পরে তাহার সহিত আবার যখন দেখা হইয়াছে. তখন কেবল জিজ্ঞাসা করিয়াছ—“ভাল আছ ত ?” হয়তো সে কথাও হয় নাই—কথাই হয় নাই—আন্তরিক বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে। হয়ত রাগে অভিমানে আর দেখাই হয় নাই । তত নাই হউক, একবার চক্ষের বাহির হইলেই, যা ছিল, তা আর হয় না ; যা যায়, তা আর আসে না ; যা ভাঙ্গে, তা আর গড়ে না । মুক্তবেণীর পর যুক্তবেণী কোথায় দেখিয়াছ ?