খলিল জিবরানের পুরো নাম জিবরান খলিল জিবরান (৬ জানুয়ারি ১৮৮৩-১০ এপ্রিল ১৯৩১), তবে তিনি কাহলিল জিবরান নামে অধিক পরিচিত ও সমাধৃত। কাহলিল জিবরান ছিলেন একজন লেবানিজ-আমেরিকান কবি, লেখক শিল্পী। এছাড়াও তিনি দার্শনিক হিসেবেও বিবেচিত যদিও তিনি দার্শনিক পরিচয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কাহলিল জিবরান সর্বাধিক পরিচিত তার লেখা ‘দ্য প্রফেট’ এর জন্য, যেটি ১৯২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত হয় এবং তখন থেকেই বইটি সর্বকালে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বইগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। এই বইটি এখন পর্যন্ত ১০০ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৩০ এর দশকে বইটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখকগনের মধ্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও আগাথা ক্রিস্টির পরই জিবরানের অবস্থান।
সন্তান
তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়
জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা!
ওরা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
যদিও থাকে তারা তোমাদের সাথে,
কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।
তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা
কিন্তু তোমার চিন্তা দিতে পারো না,
কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।
তুমি তাদের শরীরকে বাসগৃহ জোগাতে পার, কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়।
তাদের আত্মা বাস করে ভবিষ্যতের ঘরে।
যেখানে তুমি যেতে পার না, এমনকি তোমার স্বপ্নের মধ্যেও নয়।
তুমি তাদের মত হওয়ার সাধনা করতে পার,
কিন্তু তাদের, তোমার মত বানানোর চেষ্টা করো না।
জীবন পেছনের দিকে যায় না কখনো,
কিংবা গতকালের জন্যও বসে থাকে না।
তোমরা হচ্ছো ধনুক, তোমাদের সন্তানেরা হচ্ছে ছুটে যাওয়া তীর।
অনন্তের পথে চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকেন ধনুর্বিদ
যেন তার তীর ছুটে দ্রুত আর দূরে।
তুমি ধনুক; তুমি বাঁকো
ধনুর্বিদের হাতে তোমার বেঁকে যাওয়া যেন আনন্দের জন্য হয়।
তিনি কেবল চলে যাওয়া তীরটিকেই ভালেবাসেন তা নয়!
তিনি তে দৃঢ় ধনুকটিকেও ভালোবাসেন
পবিত্র রুটি
সে তোমাকে ভুট্টার শিষের মতো সংগ্রহ করে,
সে তোমাকে পরিবর্তন করে
তোমার খোসা থেকে মুক্ত করার জন্য।
শুভ্রতার জন্য
সে তোমাকে পেষাই করে
যতক্ষণ না মিহি নরম হও।
তারপর তার পবিত্র আগুনে তেমাকে ছুঁড়ে দেয়,
যাতে তুমি পবিত্র রুটি হয়ে উঠতে পারো।
ভয়
লোকে বলে সাগরে ঢোকার মুখে
নদী নাকি ভয়ে থরথর করে কাঁপে।
সে পিছনে ফিরে দেখে তার ফেলে আসা পথ
সেই পাহাড়ের চুড়ো থেকে,
বহু বন জঙ্গল, গ্রাম শহর পার করে,
লম্বা আঁকাবাঁকা পথ শেষে তার আগমন।
আর সামনে সে দেখে সমুদ্র,
এত বিশাল যার ব্যাপ্তি,
যে তাতে মিশে যাওয়া মানেই
চিরতরে হারিয়ে যাওয়া।
কিন্তু নদীর যে অন্য কোন উপায় নেই।
সে তো কখনোই ফিরে যেতে পারবে না।
কেউই ফিরে যেতে পারে না।
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ফিরে যাওয়াটা অসম্ভব।
নদীকে সাহস করে সাগরের ঝাঁপ দিতেই হবে।
কারন একমাত্র তখনই তার সমস্ত ভয়ডর মিশে যাবে।
কারন তখনই নদী বুঝবে
তার এই আগমন সমুদ্রে মিশে যাওয়ার জন্য নয়,
বরংচ এতো সমুদ্র হবারই আহবান।
অর্ধপ্রেমীদের ভালোবেসো না
অর্ধপ্রেমীদের ভালোবেসো না
অর্ধেক আনন্দের জন্য বন্ধুত্ব করো না
অর্ধেক প্রতিভা নিয়ে কাজে যুক্ত হয়ো না
অর্ধেক জীবিত থেকো না
অর্ধেক মৃত হইও না
নীরব হলে, অপরূপ নীরবতা বেছে নাও
কথা বললে গন্তব্যে না পৌঁছা পর্যন্ত বলে যাও
নিজেকে বোবা হতে বলো না যখন কিছু বলতে চাও
নীরব থাকতে চাইলে কথা নয় নীরবতাকে নেতৃত্ব দাও
যদি কিছু গ্রহণ করো তা বজ্রপাতের মতো প্রকাশ করো
মুখোশে মোহিত করে রেখো না
যদি না বলতে চাও তলোয়ার হয়ে যাও
দ্বিধাগ্রস্ত সব সংশয়ের মাথা কেটে দাও
নিস্তেজ সম্মতি ছুড়ে ফেলে দাও।
অর্ধেক সমাধান গ্রহণ করো না
অর্ধেক সত্যে বিশ্বাসী হইও না
অর্ধেক স্বপ্ন দেখো না
অর্ধেক প্রত্যাশা নিয়ে দিবা স্বপ্ন দেখো না
অর্ধেক পানীয় মেটাতে পারবেনা তোমার পূর্ণাঙ্গ তৃষ্ণা
অর্ধেক আহারে পরিতৃপ্ত হয় না ক্ষুধা
অর্ধেক পথ তোমাকে কোন গন্তব্যেই পৌঁছে দেবে না
অর্ধেক চিন্তা কোন সীদ্ধান্তই তৈরি করতে পারে না
তোমার অর্ধেক তুমিকে তুৃমি ভালোবাসো না
এটা যেন তোমার সাথে বারবার তোমার সেই পরিচিতি ব্যবধান
তুমি যখন তুমি না হও তখনই হয়ে যাও অর্ধ-জীবন
যা একটি জীবন যেখানে তুমি আদতে বাঁচো না
একটি শব্দ যা তুমি বলো না
একটি হাসি যা মুলতবি করা
ভালোবাসা যাকে তোমার ভালোবাসা হয়নি
একটি বন্ধুত্ব যা তোমার অপরিচিত
হাত বাড়াও কিন্তু পৌঁছানো যায় না
কর্ম করেও কর্মহীন থাকা
শুধু অনুপস্থিত থাকার জন্য উপস্থিত হওয়া
কাছে থেকেও তোমার নিকটতমদের কাছে তোমার ভেতর বাহির অচেনা
অক্ষমতার একমাত্র মুহূর্ত এই অর্ধেক
তুমি সক্ষম, তুমি নও অর্ধসত্তা
তুমি সমগ্র যার মধ্যে জীবিত রয়েছে অর্ধেক নয় একটি সম্পূর্ণ জীবন
বিবাহ
এরপর অলমিত্রা আবার বলল ,
আর বিয়ে সম্পর্কে , প্রভু ?
এবং উত্তরে তিনি বললেন ,
তোমরা জন্ম গ্রহণ করেছিলে এক সঙ্গে এবং চিরকাল তোমরা থাকবে এক সঙ্গে ।
মরণের সাদা পাখা যখন তোমাদের দিন গুলি ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে তখনো তোমরা এক সঙ্গে থাকবে
হাঁ , এমনকি ঈশ্বরের নীরব স্মৃতিতেও তোমরা থাকবে একত্রিত ।
কিন্তু তোমাদের মিলনের মাঝখানে কিছু জায়গা ছেড়ে দিও
আর আকাশের হাওয়াকে নেচে বেরাতে দিও তোমাদের মধ্য দিয়ে ।
একে অন্যেকে ভালোবাসো , কিন্তু ভালোবাসাকে বন্ধন বানিও না
বরং তোমাদের আত্মার মধ্য দিয়ে তাকে হয়ে উঠতে দিও একটি বহমান সমুদ্র ।
একে অন্যের পাত্র পূর্ণ করে দিও , কিন্তু এক পাত্র থেকে পান করো না
এক সঙ্গে নৃত্যগীত করো , আনন্দিত হয়ো কিন্তু তোমাদের উভয়কেই একাকী হতে দিও
যেমন বীণার তারগুলো একা হয়েও একই সুরর তরঙ্গে থরথর করে কেঁপে ওঠে ।
তোমাদের হৃদয় দান করো , কিন্তু পরস্পরের কাছে তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিও না
কারণ এক মাত্র জীবনের হাত ই পারে তোমাদের হৃদয়কে ধরে রাখতে
এবং তোমরা দাঁড়িও এক সাথে , তবে খুব কাছাকাছি নয়
কারণ মন্দিরের স্তম্ভগুলো দাঁড়িয়ে থাকে দূরত্ব বজায় রেখে
আর ওক বৃক্ষ এবং সাইফ্রেস তরু পরস্পরের ছায়ায় বৃদ্ধি পায় না।
পরাজয়
পরাজয়, আমার পরাজয়, আমার একাকীত্ব এবং আমার ঔদাসীন্য;তুমি আমার হাজারো বিজয়ের চেয়েও প্রিয়,এবং দুনিয়ার সব খ্যাতির চেয়েও মিষ্ট।
পরাজয়, আমার পরাজয়, আমার আত্মজ্ঞান ও আমার অবাধ্যতা,যদিও তুমি জানো যে আমি এখনও তরুণ ও বেগবানএবং প্রাণহীন জয়মাল্যে বাঁধা পড়ি না।আর আমি তোমার মাঝে নিসঙ্গতাকে খুঁজে পেয়েছিআর পরিত্যক্ত ও অবহেলিত হওয়ার আনন্দ দেখেছি।
পরাজয়, আমার পরাজয়, আমার উজ্জ্বল তরবারি এবং রক্ষকতোমার চোখ বলে যে,সিংহাসন মানে ক্রীতদাস হওয়াআর বুঝে যাওয়া মানে নিজেকে হেয় করা।আঁকড়ে থাকা মানেই পরিপূর্ণতাঅনেকটা কুড়িয়ে পাওয়া পাকা সুমিষ্ট ফল খাওয়ার মতো।
পরাজয়, আমার পরাজয়, আমার সাহসী সঙ্গীতুমি আমার গান, আমার কান্না, আমার নৈশব্দ শুনবে,এবং তুমি ছাড়া ডানা মেলে উড়ার কথা,সমুদ্রের গর্জন এবং যে পাহাড় আঁধারে জ্বলছে তার কথাকেউ আমাকে বলবে না।এবং তুমি একা আমার কঠিন ও কঠোর আত্মায় উঠে এসো।
পরাজয়, আমার পরাজয়, আমার মৃত্যুহীন দুঃসাহস,তুমি আমি একসাথে ঝড়ের সাথে হাসবো,আর আমরা আমাদের ভেতর মরে যাওয়াদের জন্য সমাধি রচনা করবো,আর একটি ইচ্ছা নিয়ে আমরা রোদে দাঁড়াবোএবং আরও তীব্র হয়ে উঠবো।
কবর খননকারী
একদা আমি কবরস্থ করছিলাম আমার এক মৃত
সত্তাকে, কবর খননকারী পাশে এসে বললেন আমাকে,
“এখানে যারা কবরস্থ করতে আসে তাদের মধ্যে একমাত্র তোমাকেই
আমি পছন্দ করি।“
আমি বললাম, “তুমি আমাকে অসম্ভব খুশি করেছ, কিন্তু কেন তুমি আমাকে পছন্দ কর?”
কারণ সে বললো, “তারা বিলাপ করে আসে, বিলাপ করে যায়। শুধু তুমিই হেসে হেসে আসো, হেসে হেসে যাও।“
সুখ ও দুঃখ
তোমাদের সুখ হ’ল অনবগুন্ঠিত বেদনা
তোমাদের যে হাসির ফোয়ারা ওঠে সেই কূপেই ঝরতে থাকে তোমাদের অশ্রুজলের ঝর্ণা।
এছাড়া আর কী-ই বা হ’তে পারে তবে?
তোমাদের দুঃখকে যত সত্তার গভীরে খনন করবে ততই গভীরে তার তোমাদের আনন্দসুখ ভরে উঠবে।
তোমাদের সুধাসুরা যে পানভাণ্ডে ভরা থাকে তা কি কুম্ভকারের চুল্লিতে দগ্ধশুদ্ধ নয়?
তোমাদের আর্ত মনকে যে বাদ্যবীণার সুরধ্বনি আমোদিত করে তার শূন্য ছিদ্র কি ছুরিকা দিয়ে গড়া সেই দারুকাষ্ঠ নয়?
তোমরা যখন আনন্দসুখে উৎফুল হও তখন তোমরা তোমাদের হৃদয়ের গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, তোমরা দেখতে পাবে যে যা তোমাদের দুঃখ দিয়েছিল তা-ই আদপে তোমাদের আনন্দের হেতু
তোমরা যখন ব্যাপ্ত পরতাপে কাতর তখন তোমরা পুনর্বার তোমাদের হৃদয়ের গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, তোমরা দেখতে পাবে যে তোমরা যার জন্য বিলাপ করছ তা-ই তা-ই আদপে তোমাদের আনন্দের হেতু।
কেউ বলে ’দুঃখের চেয়ে আনন্দ মহান’, কেউ বলে ’না, দুঃখই মহান’
আমি বলি, তারা অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বিরাজমান।
তারা একই সঙ্গে আসে, একজন যখন তোমাদের সঙ্গে তোমাদের অলিন্দে বসে থাকে অন্যজন তখন তোমাদের শয্যায় থাকে শয়ান।
তোমরা বস্তুতঃ তোমাদের সুখদুঃখের ওলনদণ্ডে আলম্বিত ভাসমান
তোমরা তখনই শুধু নির্ভার নিঃশূন্য যখন তোমরা ধীরস্থির ভারসাম্যতায় সুসমান।
তোমরা তখনই সুখদুঃখে উত্থিত হও পতিত হও যখন তোমরা ধনরক্ষকের স্বর্ণরৌপ্যের তুলাদণ্ডে দণ্ডিত হও অসমান।
শেয়াল
সূর্যোদয়ের সময় একটি শেয়াল তার ছায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘দুপুরের
আজকে একটা উট খাবো।” এবং সারা সকাল সে
উটের খোঁজ করল। কিন্তু দুপুরে এসে সে আবারো নিজের
ছায়ার দিকে তাকালো, এবং বললো
“একটা ইদুর হলে চলবে।”
