You are currently viewing তিনি স্বর্গে যাওয়ার জন্য শিশু হত্যা করেছিলেন

তিনি স্বর্গে যাওয়ার জন্য শিশু হত্যা করেছিলেন

১৭০৪ সালের বসন্তের কোনো এক সকালে অ্যাগনেস ক্যাথরিনা শিকিন নামের এক কিশোরী গ্রামের স্থানীয় এক কৃষকের স্ত্রীর কাছে এক গ্লাস দুধ চেয়েছিল। কৃষকের স্ত্রীর দেয়া দুধ পান করে ক্যাথরিন গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছিল। গ্রাম ছেড়ে য়াওয়ার সময় ক্যাথরিন লক্ষ করেন যে চারটি ছেলে খেলাধুলা করছে।

ঐ ৪ জন ছেলেগুলোর মধ্যে একজন ছিলো সাত বছর বয়সী, নাম হ্যান্স মাইকেল ফার্চ। অ্যাগনেস ক্যাথরিন তার কাছে গেলেন এবং তাকে বললেন সে এখানে অপরিচিত তাকে রাস্তা দেখিয়ে দিতে। রাস্তা চেনার জন্য ক্যাথরিন ছেলেটিকে সাথে নিয়ে যেতে রাজি করালো। অন্য ছেলেরাও তার সাথে যেতে চাইছিল,ক্যাথরিন বললো তোমাদের প্রয়োজন নেই তোমরা খেলাধুলা করো।

অ্যাগনেস ক্যাথরিন ও হ্যান্স মাইকেল ফার্চ একা একা জঙ্গলের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল (যা পরবর্তীতে ২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছিল)। তারা দুজন একসাথে কথা বলতে বলতে হাটতে হাটতে দিন পার করে দেয়।একজন পথচারী সাক্ষ্য দেয় যে সে দেখেছে তারা একটি পাথরের উপর বসেছিল আর মহিলাটি ছেলেটির জামায় লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে দিচ্ছিল।


সন্ধ্যা নামলে হ্যান্স মাইকেল বাড়ি যেতে চাইল। অ্যাগনেস ক্যাথরিন সে কথা শোনা মাত্রই নির্মমভাবে শিশুটিকে মাটিতে ফেলে দিলো।

হ্যান্স মাইকেল বাড়ি ফিরে যেতে দেয়ার জন্য ক্যাথরিনের কাছে মিনতি করতে লাগলো। এবং সেই সাথে চার্চ থেকে শেখা ধর্মীয় বাণীগুলো বিরবির করে পাঠ করতে লাগলো, এই ভেবে যে এগুলো পাঠ করলে ক্যাথরিনের মন শান্ত হয়ে যাবে এবং তাকে বাড়ি ফিরে যেতে দিবে।

প্রার্থনা করার পর হ্যান্সের মনে হয়েছিলো ক্যাথরিনের মনের পরিবর্তন হয়েছে এবং সে হয়তো তাকে আর বাড়ি ফিরে যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানাবে না। কিন্তু না ক্যাথরিনের মনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সে ছুড়ি বের করলো আর শিশু হ্যান্স মাইকেলের গলায় সেই ছুড়ি খপাৎ করে চালিয়ে দিলো।

শিশু হ্যান্সের দেহ যখন মৃত্যুর জন্য ছটফট করছে ক্যাথরিন অ্যাগনেস তখন চিৎকার করে বলছে,

‘‘ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুক, হে মিষ্টি দেবদূত”



অ্যাগনেস ক্যাথরিন অ্যাগনেস এর পরিকল্পনা সফল হলে, অবিলম্বে শহরে চলে আসেন (যেখানে তিনি থাকেন)।

ক্যাথরিন এই হত্যা কেনো করেছিলেন?

ক্যাথরিন অ্যাগনেস হেন্স মাইকেল নামক সেই নিষ্পাপ ছোট্ট শিশুটিকে হত্যা করেছিলেন, যাতে তিনি স্বর্গে যেতে পারেন।

অ্যগনেস ক্যাথরিন একটি খ্রিস্টান ধর্মীয় আর্চনার সদস্য ছিলেন। সেই আর্চনার ধর্মীয় গুরুরা তাদের অনুসারীদের ধাপে ধাপে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতো। অ্যাগনেস ক্যাথরিন একজন খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী ও অনুরাগী ছিলেন। জীবন সম্পর্কে তার তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না। তিনি নিজের মৃত্যু কামনা করছিলেন কিন্তু খ্রিস্ট ধর্ম অনুযায়ী আত্মহত্যা মহা পাপ।

আরো পড়ুন:  হ্যাট ট্যাক্স: ১৮শ শতকের ইংল্যান্ডে টুপির জন্য কর ও মৃত্যুদণ্ড
Image source: Cambridge University press



১৭০৪ সালে জার্মানিতে হ্যান্স মাইকেল ফার্চের নৃশংস হত্যাকান্ডটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। সেই শতাব্দীতে যেসকল খ্রিস্টানরা দুঃখে ভরা জীবন আর চালিয়ে যেতে চাইতো না তারা এই ধারণাটির সৃষ্টি করেছিল। কারন খ্রিস্টান ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ আর এই পাপের ক্ষমার কোনে সুযোগ নেই।


সেকালে খ্রিস্টান সমাজে মৃত্যুর পর আত্মহত্যাকারীকে এবং তার পরিবার কে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। আত্মহত্যাকারীর মৃতদেহ কবরস্থানে দাফনের অনুমতি দেওয়া হতো না। ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট উভয় সম্প্রদায় এই ক্ষেত্রে এক ছিল।

আত্মহত্যাকারীর দেহ কে একজন কশাই এর হাতে তুলে দেয়া হতো, (কশাইরা সেসময় নিম্ন শ্রেণির মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতো)। তারা মৃতের দেহটিকে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিতো, যেখানে মানুষের পা খুব একটা পড়তো না।

অ্যাগনেস ক্যাথরিন সেই বাচ্চাটিকে হত্যা করেছিলেন তাকে স্বর্গে পাঠানোর জন্য। যেহেতু শিশুরা হয় পবিত্র আর এই বয়সে তাদের দ্বারা কোনো পাপ সংগঠিত হয় না, আর খ্রিস্টান ধর্মেই বলা আছে শিশুরা স্বর্গে যাবে। পৃথিবী নামক নরক থেকে একজন মুক্তি দেওয়ার পুরষ্কার স্বরুপ সে নিজেও মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভ করবে।

শুধু ক্যাথরিন নয় ক্যাথরিন এর মতো আরো অনেকেই এমন হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে এইধরনের হত্যাকান্ডের নাম ছিল ‘সুইসাইড বাই প্রক্সি’

খ্রিস্টানরা তাদের এই কুসংস্কার এর দায় চাপাতো ইউরোপের ইহুদি ও স্থানীয় কেল্টদের (তাদেরকে ডাইনি আখ্যা দেওয়া হতো)। তারা গুজব ছড়াতো যে ওরা শিশুদের হত্যা করে ডাকিনীবিদ্যা ও শয়তানের উপাসনা করে।

অ্যাগনেস ক্যাথরিন এর মতো আরো যারা সেসময় শিশু হত্যা করেছিল, তারা নিজেদের ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান ভাবতো। আর তারা সকলেই ভাবতো তারা একটি শিশুকে বাঁচাচ্ছে এবং জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিচ্ছে। সেই সাথে নিজেও মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভ নিশ্চিত করছে।


কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির গবেষণা তথ্য অনুযায়ী ১৬১২ সাল থেকো ১৮৩৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপে প্রক্সির মাধ্যমে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১১৬ টি। হত্যাকারীরা কখনও কখনও অগ্নিসংযোগের মতো অন্যান্য অপরাধ ও করেছেন। তাদের অনেকেই নিজেদের অপরাধ পরবর্তীতে স্বীকার করেছিল, আর কারাগারে জীবন কাটানোর পরিবর্তে তারা মৃত্যুদন্ডাদেশ এর আশা করতন; যেহেতু জীবন সম্পর্কে তাদের কোনো আগ্রহ ছিলো না।

শুধু অপরিচিত মানুষের দ্বারা প্রক্সি সুইসাইড হয়নি, কখনো কখনো মায়েরা নিজেদের সন্তানকেই শিকার হিসেবে বেছে নিতো। ইতিহাসবিদরা এই ঘটনাকে নাম দিয়েছেন classical infanticide.

নির্যাতন এড়ানোর জন্য, আত্মঘাতী খ্রিস্টানরা তাদের উদ্দেশ্য আদালতে স্পষ্ট করে দেয়। তারা তাদের স্বীকারোক্তিতে বলতো যে তারা শিশুটিকে পৃথিবীর নরক থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের স্বর্গে পাঠিয়েছে এবং যখন তার মৃত্যু হবে এই কাজের পুরষ্কার হিসেবে সে নিজেও স্বর্গ লাভ করবে।

১৬৯১ সালে মারিয়া হেলেনা ল্যাঙ্গিন নামে এক নারী “অনৈতিক জীবন” যাপনের অভিযোগে নুরেমবার্গের কারাগারে বন্দী হয়েছিলেন। তার অপকর্মের জন্য তাকে মৃত্যুর পর নরকে যেতে হবে এজন্য তিনি কারাগারের একজন বধির বন্দিকে ইট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছিলেন, স্পষ্টতই কারণ ছিল কারাগারে কোনো শিশু সে পায়নি যে হত্যা করবে। এর পরিবর্তে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে হত্যা করেই মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভ করতে চেয়েছেন।

১৭০৩ সালের জুন মাসে একজন ভিক্ষুক মহিলা তার শিশুকে পেগনিৎজ নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছিলেন, ওই সেই একই কারণ শিশুটিকে হত্যা করে সে স্বর্গে পাঠিয়েছে, এবার সে নিজেও স্বর্গ লাভ করবে।

১৭৪৬ সালে জার্মানির স্প্যান্ডাউ কারাগারে একজন মহিলা নিজেকে তার নারকীয় জীবন থেকে মুক্তি পেতে সেই সাথে মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভ করার জন্য কারাগারের অন্য একজন বন্দীর ছোট শিশুকে হত্যা করেছিলেন।

১৬৭০ এর দিকে স্টকহোমে প্রক্সি সুইসাইড একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। পরের শতাব্দীতে শহরটি এই ধরণের ৬২ টি ঘটনা ঘটেছে।

প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো নারীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে লিঙ্গ কোনো না কোনোভাবে একটি ভূমিকা রেখেছে। এই ঘটনাগুলোর পেছনে কোনো অচেনা মানসিক রোগের উপাদান অবশ্যই থাকতে পারে। তবে এসবের পেছনে সবচেয়ে বড় দায় ধর্মান্ধ খ্রিস্টান ধর্মীয় গুরুদের। যাদের কুমন্ত্রণায় প্রাণ হারাতে হয়ে শত শত নিষ্পাপ শিশুদের।

আরো পড়ুন:  লেপা রেডিক : নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক সাহসী কিশোরীর বিদ্রোহ

Featured Photo by Joshua Eckstein on Unsplash

Mehadi Bhuiyan

Mehadi Bhuiyan holds a BA in English Literature from the National University of Bangladesh. His academic interests include literature, history, and cultural studies, with a particular focus on modern and contemporary writing. He works as a freelance writer, researcher, and editor, specializing in literary analysis, historical narratives, and cultural topics.

Leave a Reply