You are currently viewing মধ্যযুগে মানুষ নির্যাতনের কিছু ভয়াবহ পদ্ধতি

মধ্যযুগে মানুষ নির্যাতনের কিছু ভয়াবহ পদ্ধতি

ইতিহাসের পাতায় আপনি হয়তো মধ্যযুগে অপরাধের জন্য হাতের আঙুল কেটে ফেলা কিংবা হাত কেটে ফেলার কথা শুনে থাকবেন। কিন্তু মধ্যযুগে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর নির্যাতন প্রচলিত ছিলো; যেগুলো মানুষের হাত কিংবা আঙ্গুল কেটে ফেলার চাইতে কয়েক গুণ বেশি যন্ত্রণাদায়ক।

যেসকল নির্যাতন পদ্ধতির কথা এই লেখায় উল্লেখ মধ্যযুগের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে সুদূর চীন পর্যন্ত  দেশগুলোর নির্যাতন পদ্ধতির কথা উল্লেখ থাকবে।

ব্রেকিং হুইল

ব্রেকিং হুইলে একটি বিশাল কাঠের চাকা থাকতো। সেই চাকায় অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যাক্তিকে বেঁধে মারধর করা হতো। এই চাকাটিকে ঘুরানো যেতো তাই চাকার নিচে আগুন জ্বালিয়ে তা ঘুরানো হতো। ফলে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যাক্তির শরীর আগুনের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় কিছু মুহূর্তের জন্য পুড়ে যেতো।

Photo by Prisma/UIG/Getty Images

এই চাকায় মানুষকে বাঁধার জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যাক্তিকে একটু বেশি বাঁকা করে বাঁধা হতো, যাতে কষ্ট বেশি হয়। বেশিরভাগ সময় ব্রেকিং হুইল দ্বারা নির্যাতনকারীরা অপরাধী কে সরাসরি হত্যা করতো না। কিন্তু অতিরিক্ত শারিরীক ব্যাথা, সংক্রমণ এবং ক্লান্তির কারনে বেশিরভাগেরই বাঁধা থাকা অবস্থায় মৃত্যু হতো।

স্প্যানিশ টিকলার বা সুড়সুড়ি

যদিও নামটা শুনে আপনার মোটেও কোনো নির্যাতনের ডিভাইস বা যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে না। তবে এই যন্ত্রের নামের সাথে কিন্তু কাজের কোনো মিল নেই। স্প্যানিশ টিকলার বা সুড়সুড়ি যন্ত্রটি একটি অত্যন্ত ধারালো নখর-সদৃশ যন্ত্র যা নির্যাতনকারীরা তাদের হাতে ধরে চামড়ার উপর চাপ প্রয়োগ করে নির্যাতিত ব্যক্তির গায়ের মাংস ছিঁড়ে ফেলত।  সাধারণত, এই ধরনের নির্যাতন জনসমক্ষে করা হত এবং নির্যাতিতা ব্যক্তির শরীরে কয়েক ইঞ্চি পর্যন্ত গভীর ক্ষত করা হতো।

Photo Courtesy: Freelancer

বেম্বো টর্চার

এই নির্যাতনটি আমার কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত মনে হয়েছে। আপনি হয়তো জানেন বাঁশ পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদ। কিছু প্রজাতির বাঁশ ২৪ ঘন্টায় ৯১০ মি.মি বা ৩৬ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আর এটাকেই নির্যাতনের উপায় হিসেবে কাজে লাগিয়েছে মধ্যযুগের মানুষরা। তারা নির্যাতিত ব্যাক্তিকে সদ্য অঙ্কুরিত বাঁশের উপর চ্যাঙ্গদোলা করে বেঁধে রাখতো আর বাঁশ গুলো ধীরে ধীরে নির্যাতিতর শরীর ভেদ করে উঠতে থাকতো। এ ধরনের মৃত্যু ছিলো সবচেয়ে ধীর ও বেদনাদায়ক।

Phot Courtesy: Youtube

জীবন্ত মানুষের শরীরের চামড়া তুলে ফেলা

এই শাস্তিতে অপরাধে দন্ডিত ব্যক্তির জীবন্ত অবস্থাতেই শরীরের চামড়া তুলে ফেলা হতো। শুনতে খুবই বিভৎস মনে হলেও এটা সত্যি। শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যাক্তির হাত ও পায়ের পেশির চামড়া তুলে ফেলা হতো। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা ছিলো এই যে; এই শাস্তি পাওয়ার পরেও তারা সহজে মারা যেতো না। চামড়া ছাড়াই কয়েকদিন বেঁচে থাকতো। চামড়াশূণ্য দেহে তাদেরকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। আর এই সময় তাদের শরীরে কীটপতঙ্গরা হাঁটাচলা করতো। সাধারণ মানুষ নির্যাতন করার জন্য তাদের দিকে ছোট ছোট পাথর ছুঁড়ে দিতো।

আরো পড়ুন:  কৃষক যখন সম্রাট: চীনের ইতিহাসে ক্ষমতার পালাবদল
Photo Courtesy: All that interisting

নিষ্ঠুর নির্যাতন ও সংক্রমণে তাদের শরীরে শীঘ্রই পচন ধরতে শুরু করতো। আর ধীরে ধীর তারা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

চাইনিজ ওয়াটার টর্চার
 

এই নির্যাতন পদ্ধতিটি আমার কাছে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। চীনারা অপাধীদের এই নির্যাতন করতো। শারিরীক যন্ত্রণা ছাড়া যে কিভাবে নির্যাতন করা যায় এটা তার সবচেয়ে ভালো উদারহারণ। এই শাস্তিতে অপরাধীকে বেঁধে তার উপরে পানির পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে অপরাধীর কপালে বা মাথায় এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে পানি পড়তে থাকে।

Photo Courtesy: Wikipedia

শুরুতে অপরাধীর তেমন কিছু অনুভব হয় না। সময় বাড়ার সাথে সাথে একেকটি পানির ফোটাকে তখন নির্যাতিত ব্যক্তির পাথরের মতো মনে হয়। শারিরীক শাস্তির চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক শাস্তি আরো ভয়ংকর চাইনিজ ওয়াটার টর্চার তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

লিংচি

লিংচি শব্দটি চীনা শব্দ। যার অর্থ হাজার টুকরো করে মৃত্যু দেওয়া বা স্লো স্লাইসিং (ধীরে ধীরে অঙ্গ কাটা)। এই নৃশংস অত্যাচারটি চীনের প্রাচীন যুগ থেকে উনিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত নিয়মিত চলমান নির্যাতনের অনুশীলন ছিল।

এই নির্যাতনে বন্দী বা দোষী ব্যক্তিকে কাঠের খন্ডে বেঁধে রাখা হতো। তারপর ধারালো ছুরি দিয়ে  শরীরের একাধিক টুকরো করা হতো। প্রথমে শরীর বুক, হাত ও পরে অন্যান্য অংশ অপসারণ করা হতো।

বুকর পাঁজরের হাড় ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হাড় দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত শরীরের মাংস ধীরে ধীরে খুলে নেওয়া হতো।

Photo Courtesy: Medium

এই শাস্তি প্রক্রিয়া খুবই ধীর গতিতে চলতো। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে ৩ দিনের বেশি সময় লাগতো এবং ৩০০০ এরও বেশি বার শরীর কাটা হতো।

এই নৃশংস শাস্তি কোনো সাধারণ অপরাধের জন্য দেওয়া হতো না। লিংচি শুধুমাত্র  রাষ্ট্রদ্রোহিতা, গণহত্যা বা পিতমহত্যার মতে ঘৃণ্য ও গুরুতর অপরাধের জন্য দেওয়া হতো।
অত্যাচারের এই পদ্ধতিটি খ্রিস্টীয় ১০ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং প্রায় এক হাজার বছর পর ১৯০৫ সালে এই নৃশংস পদ্ধতি নিষিদ্ধ করা হয়।

লিংচির পদ্ধতির শেষ শিকার ছিলেন এক ব্যক্তি, ম ছিলো ফৌচৌলি। সে একজন মঙ্গোলিয়ান রাজপুত্রকে হত্যা করেছিলো। চীনের শেষ রাজবংশ চিং রাজবংশ (১৬৪৪-১৯১১) তাদের রাজত্বের শেষ দিনগুলোতে এই শাস্তির পরিমান ছিলো অতিরিক্ত পরিমানে।

আরো পড়ুন:  হ্যাট ট্যাক্স: ১৮শ শতকের ইংল্যান্ডে টুপির জন্য কর ও মৃত্যুদণ্ড

সুইডিশ ড্রিংক

তর্কাতীতভাবে এই তালিকায় সবচেয়ে ভয়াবহ নির্যাতন হল সুইডিশ ড্রিংক। এটি মানুষের বর্জ্য দিয়ে তৈরি করা হতো। ঠিকই শুনছেন এটি মানুষের প্রস্রাব ও মূত্র মিক্সড করে তৈরি হতো। আর এটিই নির্যাতিতদের পান করাতে বাধ্য করা হতো। জোড় করে এই বিশ্রী পাণীয় পান করানোর ফলে নির্যাতিতদের পাকস্থলীতে অশান্তির সৃষ্টি হতো।

Photo Courtesy: Youtube

এই অত্যাচারের উৎপত্তি হয় ইংল্যান্ডের ৩০ বছর ধরে চলা গোলাপের যুদ্ধের সময়। এটিকে “সুইডিশ ড্রিংক” বলার কারণ হল যে সুইডিশরা এটিকে বন্দী জার্মান সৈন্যদের উপর নির্যাতনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিল। আর পরবর্তীতে জার্মানরাই এই শাস্তিকে সুইডিশ ড্রিংক বলে প্রচার শুরু করে।

স্কাফিজম

স্কাফিজম ছিলো মধ্যযুগের ভয়াবহ নির্যানগুলোর একটি। এই শান্তি পদ্ধতিতে অপরাধী কে উলঙ্গ করে একটি ছোট নৌকায় এমনভাবে ফিট করে বাঁধা হতো যে সে শরীর নড়াচড়াও করতে পারতো না। এরপর শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যাক্তিকে অতিরিক্ত দুধ ও মধু খায়ানো হতো যেনো তার ডায়রিয়া হয়। এর পুরো শরীরে মধু মেখে দেওয়া হতো। বিশেষ করে মুখ ও যৌনাঙ্গে।

Photo Courtesy: Blockdit

এরপর নৌকাটি জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। বিশেষকরে এমন জলাভূমিতে যেখাতে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি। মলমূত্র ও মধুর গন্ধ পোকামাকড়দের আকৃষ্ট করতো। বিশেষ করে মাছিরা বেশি আকৃষ্ট হতো। মাছিদের ডিম ও লার্ভা শরীরে সংক্রমণ শুরু করতো সেই সঙ্গে ছিলো অতিরিক্ত মধু খাওয়ার ফলে শরীর হতে সৃষ্ট কৃমির উৎপাত।

এই মৃত্যু ছিলো অতি ধীরগতির। গরম আবহাওয়া, খাবার জলের অভাবে ডিহাইড্রেট সেই সাথে নিজের মলমূত্রে শরীর লেপ্টে থাকা। সত্যিই ভাবতেই ভয়ংকর লাগছে। প্রাচীণ গ্রীক ও পারস্যে এই স্কাফিজম টর্চার পদ্ধতি খুব জনপ্রিয় ছিল।

Mehadi Bhuiyan

Mehadi Bhuiyan holds a B.A. in English Literature. He has a long-standing interest in writing, with a focus on historical and mythological themes. His work often explores the cultural and literary connections between past and present. Outside of writing, he enjoys reading across genres and is passionate about music and singing.

Leave a Reply